বিগত কয়েকটা বছরে অনুবাদের পাশাপাশি অনেকগুলো সম্পাদনা করাও হয়ে গেল। আমাকে সম্পাদক হিসেবে কাজ করাতে পারার কৃতিত্ব পুরোটাই নিঝুমের। বেনজিন প্রকাশনীর প্রকাশক নিঝুম, আমার প্রিয় ছোট ভাই। বেনজিন প্রকাশনী কাজ শুরু করার পর থেকে শুধু যে বই প্রকাশ করে ব্যবসা করেছে তা নয়, বাংলাদেশের সাহিত্যে নতুন একটা মাত্রা প্রতিষ্ঠিত করেছে। ড্রাকুলা বইটার বাংলা অনুবাদ আগেও ছিল, কিন্তু এই নবীন প্রকাশনীর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর, বিশ্বের ক্লাসিক বইগুলোর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের যে জোয়ার এসেছে, সেটা বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে। তরুণ একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সময়ের চেয়েও এগিয়ে থাকা চিন্তা আর সাহস যে ফলাফল বয়ে আনলো সেটা সত্যিই অসাধারণ। শুরু থেকে একসাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে, এবং হৃদ্যতার সুবাদের বেনজিন প্রকাশনীকে নিজের মনে হয়, প্রকাশনার সামনে-পেছনে থাকা সবাই আমাকেও কাছের মানুষ মনে করেন, সবমিলিয়ে বেনজিনের এই সাফল্যে আমি সত্যিই খুবই গর্বিত।
বেনজির প্রকাশনী যে শুধু বই নিয়ে ব্যবসার চেয়েও বেশি কিছু করছে তার প্রমাণ ড্রাকুলার এই সংস্করণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে আগেই জানতাম যে এই সংস্করণের প্যাকেজে কী কী থাকছে, কিন্তু তারপরেও প্রতিটা আইটেম যখন বের করে প্রথমবারের মত হাতে নিচ্ছিলাম তখন কৈশোরের সেই নির্মল শিহরণ যেন নতুন করে অনুভব করছিলাম। এক কথায় বললে, কাহিনির ড্রাকুলাকে যেন জীবনের আরেকটু কাছাকাছি এনে দিল এই বইটা।
আজকাল ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই লিখতে বসি, তাহলে দিনটা ভালো যায়। আজকেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। লেখার মাঝখানে কুরিয়ারের কল আসলো। বইটা নিয়ে এসেই খুলে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। বইটার সাথে অনেক আবেগ জড়িয়ে আছে এইজন্য প্যাকেজটা খোলার সময় অনেকগুলো আনুভূতি একসাথে কাজ করছিল। বইটা নিয়ে কাজ করার পর থেকে দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। একটা কাজের পেছনে পুরো টিমের অনেক না বলা অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, অনুভূতি থাকে, সেগুলো খুব দ্রুত আসা যাওয়া করছিল মনের পর্দায়।
কৈশোরের শুরুতে ড্রাকুলা পড়ে ভালো লেগেছিল। কিন্তু বড় হওয়ার পর, টিন এজের শেষদিকে, মূল বইটা পড়ার পর মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, পাঠক হিসেবে নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছিল। এটা নিয়ে পরিচিতদের মধ্যে কথাও বলেছিলাম। বলছি, ২০১১-১২ সালের কথা। তখন কয়েকটা অপ্রকাশিত অনুবাদ শেষ করেছি মাত্র। বন্ধুদের কয়েকজন বলল, তুই করে ফেল।কিন্তু আমি অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত। পুরো বইতে সময় দেয়ার মতো সময় নেই। ড্রাকুলার একটা কমিকস পেলাম, যেটাতে বইয়ের আসল কাহিনি বেশ ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। তখন আমি বাংলাদেশের প্রথম কিশোর অনলাইন লিটারেরি সাইট ‘আজবদেশ’ শুরু করেছি। ড্রাকুলার ওই কমিকসটা অনুবাদ করে প্রকাশ করতে লাগলাম। আজবদেশ চালিয়ে যেতে পারিনি কিন্তু অনুবাদ করা ওই কমিকসটার সফটকপির দুটো পর্ব এখনও আছে বাংলাদেশে প্রথম ও অসাধারণ দুইটা ইবুক প্লাটফর্ম ‘বইটই’ এবং ‘সেইবই’-তে। এতবছর ধরে পাঠকরা সেগুলোকে ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছেন। সিরিজের বাকি অংশটুকু প্রকাশ করার অনুরোধও নিয়মিত পাই, কিন্তু কেন করছি না, সেটার কোনো সদুত্তর আমার কাছে এখন পর্যন্ত নেই।
টাইম ফ্লাইস। মাঝে অনেকবছর কেটে গেল, অপ্রত্যাশিতভাবে ঐশ্বর্য প্রকাশ শুরু করে ফেললাম। লেখক, অনুবাদক, প্রকাশকদের সাথে আলাপ আলোচনা বাড়ল অনেক, যদিও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ওইসময়ও অনেককে বলেছি, ড্রাকুলার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের ইচ্ছার কথা । একদিন ফাহাদ আল আব্দুল্লাহকে বললাম। সে শুনে খুবই এক্সাইটেড। আমি বললাম , আপাতত আমরা আমাদের অন্য প্রায়োরিটি গুলো নিয়ে কাজ করি, তারপর আস্তেধীরে করব। বেনজিন প্রকাশনীর প্রকাশক নিঝুমের সাথেও একদিন শেয়ার করলাম চিন্তাটার কথা। আমি ভেবেছিলাম, এসব পাগলামি চিন্তা কেউ গুরুত্ব দেবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে একদিন নিঝুম ফোন দিয়ে বলল, “ভাই ড্রাকুলার অনুবাদ করতে চাই।” শুনে খুশি হলাম। কিন্তু যখন বলল, সে চায় অনুবাদটা আমি করি তখন খুব লোভ লাগলে বটে কিন্তু অন্যান্য ব্যস্ততার কারণে কাজটা সম্ভব হবে বলে মনে হল না। সেটাই বললাম। শুনে নিঝুম বলল, “ভাই, আপনি কয়েকদিন ভাবেন।”
আমি তখনও খুব সিরিয়াসলি নিই নি প্রস্তাবটা কারণ ত্রিশ চল্লিশ বছর ধরে চলে আসা একটা বই, আবার নতুন করে করার ব্যবসায়িক ঝুকি নেয়ার মত মানুষ খুব বেশি থাকার কথা নয়।প্রথমবার আমার মনে হয়েছিল, নিঝুম সম্ভবত আমার প্রতি হৃদ্যতা দেখাতে কাজটা করতে চাচ্ছে।
কয়েক সপ্তাহ পর নিঝুম আবার ফোন দিল। এবার ওর কথা শুনে বুঝলাম, ছেলেটা আসলেই চায় কাজটা আমি করি। কিন্তু আমি তখন টাকা কামানোয় ব্যৃস্ত। জীবনের জন্য অনেক চাওয়াকে ছেড়ে দিতে হয়, ব্যাপারটা আমি বুঝি কিন্তু নিঝুম আমার চেয়ে ছোট সে নাও বুঝতে পারে। প্রায় আধাঘন্টার কথোপকথনে আমাকে কনভিন্স করতে না পেরে মন খারাপ করল ছেলেটা। কখনও ওকে বলা হয়নি, আমারও খুব মন খারাপ হয়েছিল।
আমার মনে হয়েছিল, ছেলেটা এবার মাথা থেকে ড্রাকুলার ভূত নামিয়ে ফেলবে।কিন্তু এরপরে যেটা করল সেটা, একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিঝুমের অসাধারণ যোগ্যতার পরিচয় দেয়। সে ড্রাকুলা নিয়ে আগ্রহী এরকম অনেকগুলো মানুষকে এক করে ফেলল। এবং সবাইকে এক সাথে করে অসাধারণ একটা প্রোজেক্ট করে ফেলল যেটা বাংলায় পূর্ণাঙ্গ ক্লাসিক অনুবাদের জোয়ার এনে দিল বললে ভুল হয় না।
পরবর্তীতে জানতে পেরেছি প্রিয় লুত্ফুল কায়সার ভাই, আলাদাভাবে ব্রাম সে্টাকারের ড্রাকুলা নিয়ে কাজ করছিলেন। তাকে নিয়ে বেনজিন কাজটা শেষ করার খুব ভালো সিদ্ধান্তটা নিল। কিন্তু নিঝুম ছেলেটা বোধহয় আমাকে কোনোভাবেই ছাড়তে চায়নি। এরপর অনেক অনেকদিন পরে আবার আমাকে জানালো, ড্রাকুলা প্রোজেক্টের লেটেস্ট আপডেট। সাথে একটা নন-নেগোশিয়েবল প্রোপোজাল। প্রস্তাবটা হল, ড্রাকুলার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদটার সম্পাদনা করে দিতে হবে। এবারও রাজি হতে সময় নিলাম, কারণ কাজের ক্ষেত্রে কমিটমেন্ট রাখার বেস্ট চেষ্টা করি। ব্যস্ততা বলছিল, ছেড়ে দিলেই আরামে থাকা যাবে, কিন্তু মন বলছিল ‘সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই’। রাজি হলাম। এখানে একটা কথা যুক্ত না করলে প্রকাশন হিসেবে নিঝুমের ভিশনটা পরিষ্কার হবে না। রাজি হতে সময় নিচ্ছি দেখেই কিনা জানিনা, বইটা সম্পাদনার জন্য নিঝুম সর্বোচ্চ প্রারিশ্রমিক অফার করেছিল। এরপরেও ছেলেটাকে আমার পেছনে সময় দিতে হয়েছে, সময়মত যেন সম্পাদনা শেষ করতে পারি সেজন্য নিয়মিত ফলো-আপ দিয়েছে, কাজ এগিয়েছে শুনে খুশি হয়েছে, বহুদিন আগায়নি শুনে মন খারাপ করেছে। সব কিছু মিলিয়ে বইটা শেষ হয়েছে। বাজারে এসেছে, পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। সম্ভবত ইতিহাসও সৃষ্টি করেছে (যেহেতু আমি বইয়ের সাথে যুক্ত তাই জোর দিয়ে বলতে পারছি না)।
বেনজিন থেকে প্রকাশিত হওয়ার আড়াই বছরের মাথায় আসলো এই স্পেশাল এডিশন। ড্রাকুলা যারা ভালোবাসেন তাদের জন্য এই মুদ্রণটা যে বিশেষকিছু হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বইয়ের চেহারায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রকাশিত বইয়ের ভাইব, চারপাশে লাল রঙের বর্ডারে বিদ্রহী আর রক্তাক্ত অনুভূতি একসাথে মনকে সত্যিই নির্মল অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ সঞ্চার করে। লেখক ব্রাম সে্টাকারকে লেখা শার্লক হোমসের স্রষ্টা কোনান ডয়েলের শতাব্দি প্রাচীন চিঠিটা বইটার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়। বইয়ের ভেতরের রঙিন অলংকরণগুলো কাহিনির অনুভবকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। দশটা ক্যারেক্টার কার্ড চরিত্রগুলোকে নিয়ে আসে বাস্তবের কাছে এবং সবশেষে দুই পাশে ছাপা লিটারেরি ম্যাপ যেন ড্রাকুলার দুনিয়াকে বইয়ের দুনিয়া থেকে বাস্তবেই নিয়ে এসেছে। সত্যি বলছি, একবিন্দু বাড়িয়ে নয়। আমার অনুভূতিগুলোই লিখে রাখার চেষ্টা করছি শুধু।
এই অ্যান্টিক এডিশনের মাধ্যমে বেনজিন প্রকাশনী শুধু একটা বই আমাদের হাতে তুলে দেয়নি, তুলে দিয়েছে একটা অভিজ্ঞতা। যে অভিজ্ঞতা ড্রাকুলার স্বপ্নময় জগত্কে নিয়ে এসেছে বাস্তবতার আরও কাছাকাছি, দুই জগতের মধ্যে তৈরি করেছে একটা সেতু। ঠিক এই কাজটাই করে ওয়াল্ট ডিজনি, মারভেল, ডিসি, হ্যারি পটার মিউজিয়াম, ইত্যাদি। অনেকের কাছে মনে হতে পারে, বেশি বলছি, কিন্তু সত্যিটা হল মোটেই বেশি বলছি না, ঠিক যেই অনুভূতি থেকে হ্যারি পটার মিউজিয়ামে এত দর্শনার্থী আসে, মারভেলের কসপ্লে এত বড় ফেসি্টভাল হয়, ড্রাকুলার এই সংস্করণও ঠিক সেই অনুভূতি থেকে আসা। বাজেটে কমতি থাকতে পারে কিন্তু সৃজনশীলতা, ভালোবাসা আর অনুভূতির কমতি নেই। এর মাধ্যমে বেনজিন প্রকাশনী নিজেদের একটা নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল। অন্য প্রকাশনীগুলোর জন্য নতুন ভাবনার দুয়ার খুললো। সবকিছুর জন্য বেনজিনের প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, আর অনেক অনেক শুভকামনা।
আরেকটা মজার ইচ্ছা জানিয়ে শেষ করতে চাই। ড্রাকুলোর কোনো নতুন এক সংস্করণ উপলক্ষ্যে আমরা একটা কসপ্লে আয়োজন করব। কেউ মিনা সেজে আসবে, কেউ লুসি, হলিউড অভিনেতা হিউ জ্যাকম্যানের কোনো ফ্যান হয়তো ভ্যান হেলসিং সেজে আসবে, আমি আসবো কাউন্ট ড্রাকুলা সেজে।
মহিউল ইসলাম মিঠু
আগস্ট ৩১, ২০২৪
ইউটিউবে ভিডিও দেখতে এই লিংকে ক্লিক করতে পারেন। https://youtu.be/LpN4J-iI6CI