স্বাধীনতার পর অনেক বছর কেটে গেছে কিন্তু সুশাসন ও গণতন্ত্র এখনও বাংলাশের মানুষের ভাগ্যে জুটলো না। এর পেছনে অনেকগুলো কারণের কথা শোনা যায়। যেমন: গণতন্ত্র নিয়ে দেশের মানুষের ধারণা, জনপ্রতিনিধি বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে দেশের নাগরিকদের অভ্যাস, রাজনৈতিক মেরুকরণ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার অভাব।
একটা ঘটনা বললে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চিন্তার ব্যাপারে একটা ভালো ধারণা পাওয়া যাবে।
২০০৭ সালে, ১/১১-এর পর, এক গবেষণায় নরসিংদীর স্থানীয় জনগণকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “ধরুন, দুজন প্রার্থী আছে। একজন সৎ এবং দুর্নীতি করেন না। আগে তিনি রাজনীতি করেননি। অন্যজন দুর্নীতিগ্রস্ত কিন্তু বহু বছর ধরে রাজনীতিতে আছেন। আপনি কোনজনকে ভোট দেবেন? সাধারণ ভোটাররা জানিয়েছিলেন, যিনি দুর্নীতি করেন, কিন্তু অভিজ্ঞ, তাঁকেই ভোট দেবেন। কারণ, কোনো সমস্যা হলে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ সাহায্য করতে পারবেন। অনভিজ্ঞ ব্যক্তি তা করতে পারবেন না।” এটা থেকে বোঝা যায়, রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা ও প্রত্যাশা কেমন। ২০২৫ সালে একই প্রশ্নের একই জবাব পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা।
যে গবেষণার কথা বলছিলাম সেই গবেষণাটা করেছিলেন সমাজবিজ্ঞানী আরাইল্ড এঙ্গেলসন রুড। প্রথম আলোতে সম্প্রতি তার একটি সাক্ষাত্কার প্রকাশিত হয়েছে। মি রুড হলেন নরওয়ে ইউনিভার্সিটি অব অসলো-এর সাউথ এশিয়া স্টাডির অধ্যাপক। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন। সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত হওয়া ইন্টারভিউতে উপরের বিষয়গুলোর কথাই বলেছেন তিনি।
বাংলাদেশের রাজনীতির মেরুকরণ এদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুইটি মেরু দেখা যায়। যে শক্তি ক্ষমতা বা দায়িত্বে আসে, সে সব দখল করে, আর অপরপক্ষ বঞ্চিত হয়। আগে চাঁদাবাজি করত, আওয়ামী লীগ এখন করছে বিএনপি। এই ক্ষেত্রে মি রুডের প্রস্তাব হল, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা। বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি থাকবেন। তাঁরা সবাই সংসদে আসবেন, বিতর্ক হবে এবং সেখানেই সমস্যার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
এই মেরুকরণের সাথে যুক্ত হয়েছে হিংসাত্মক রাজনীতি।এখানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং শাসকদের প্রতিনিধিরা একধরনের দায়মুক্তির অনুভূতি নিয়ে ঘোরে। কোনো কিছুই যেন তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। এই দায়মুক্তি মোকাবিলা করা উচিত। এই দায়মুক্তি এমন সমাজ, রাষ্ট্র তৈরি করে, যেখানে কিছু লোক অনেক বেশি আর অন্যরা খুবই কম পায়। বাংলাদেশেও তা-ই হয়েছে। কিছু অলিগার্ক বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারপর বাকি জনগণ কোণঠাসা।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরেকটা বড় বাধা হল, প্রতিষ্ঠান হিসেব রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্ষমতার অভাব।সরকারি জনবলের দিক থেকে বাংলাদেশে বেশ ছোট। অনুপাতে নরওয়েতে এর ১০ গুণ বেশি আছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্র দুর্বল। “দেশের বড় অংশে কার্যত রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই।” বলে উল্লেখ করেন রুড। প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করা, ক্ষমতার মেরুকরণ, এই দুটি বিষয় বন্ধ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আবার বাংলাদেশে বংশগতভাবে নেতা হওয়ার একটা প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ আছে। মেরুকরণ বন্ধ না হলে এই রেওয়াজ থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় আসলে নেই। কারণ মানুষ আসলে নেতার ছেলেকে সমর্থন দিচ্ছে না, সমর্থন দিচ্ছে, ক্ষমতার যে নেটওয়ার্ক সেই নেটওয়ার্কের উত্তরাধিকারীকে। এই নেটওয়ার্কটা তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে, বাইনারি এই নেটওয়ার্কের দুইদিকে আছে দুইটি রাজনৈতিক দল।
সবমিলিয়ে বলা যায়, এই সমস্যাগুলো থেকে বের না হয়ে আসতে পারলে, দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীল এবং অংশগ্রহনমূলক রাজনীতি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। আবার পুরো কাজটি দ্রুত করাও সম্ভব নয়। আবার রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এই বিষয়গুলোতে পুরোপুরি উলে্টা পথে চলার প্রবণতা এবং কখনও কখনও তীব্র ইচ্ছা দুটোই অতীতে দেখা গেছে। অল্পদিনে এই সমস্যা থেকে বের হয়তো হয়ে আসা যাবে না। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় ঐক্য অবশ্যই দরকার। রাজনৈতিক পছন্দ যেমনই হোক না কেন এই মৌলিক বিষয়গুলোয় যদি বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে, তাহলে যে সুশাসনের স্বপ্ন আমরা দেখছি সেটা পাওয়া সম্ভব হবে তো না-ই, বরং আবার নতুন কোনো স্বৈরাচারের কবলে পড়া হবে সময়ের ব্যাপার মাত্র। যেটা আমরা বিগত পাঁচ দশকে বারবার হতে দেখেছি।
The interview can be found here.