গার্ডিয়ান লাইফ ইন্সুরেন্স পলিসি নিয়ে ধরা খাইলাম

গার্ডিয়ান লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে একটা লাইফ ইন্সুরেন্স কিনেছিলাম। কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। কিভাবে হলাম সেটাই বলতে যাচ্ছি।

বীমা জিনিসটাকে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। অবশ্য ভালো চোখে দেখার মত কোনো পদক্ষেপ বা কর্মকাণ্ড কোনোটাই বীমা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে দেখা যায়নি। আর আমাদের সরকারগুলোও সবসময়ই সাধারণ মানুষের ভালো থাকা আর অধিকারগুলোর ব্যাপারে উদাসীন।

গত বছর অক্টোবরের দিকে আমি ভাবলাম একটা লাইফ ইন্সুরেন্স নেয়া উচিত। বেশ কয়েকটা বীমা কোম্পানির প্রতিনিধির সাথে কথা বলে খুব একটা বিশ্বাস পেলাম না। পরে অনলাইনে দেখলাম, গার্ডিয়ান লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির কিছু পলিসি অনলাইনেই কেনা যায়। এদের ব্যাপারে খোঁজ খবর করার সময় অনলাইনে শুধু কোম্পানির বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ছাড়া তেমন কিছু পেলাম না। তেমন কিছু মানে গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা বোঝাচ্ছি। অবশ্য পাওয়ার আশাও করিনি।যাই হোক, কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেখলাম, এই ইন্সুরেন্স কোম্পানির সহযোগিতায় আছে অ্যাপেক্স, ব্র‍্যাক আর স্কয়ার। তিনটা ভালো কোম্পানি যেহেতু আছে, তাই একটু ভালো মনোভাব আসলো। 

গার্ডিয়ান লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি ডিজিটাল মাধ্যমেও ইন্সুরেন্স পলিসি বিক্রি করে। এদের একটা অ্যাপ আছে, নাম ‘ইজি লাইফ’। অবশ্য অ্যাপ শুধু অ্যান্ড্রয়েডে আছে, আইওএসে নেই। ফলে ফোন বদলানোর পর বেশ সমস্যায় পড়তে হল। এছাড়া বিকাশ অ্যাপ থেকেও এই কোম্পানির হেলথ ইন্সুরেন্স পলিসি কেনা যায়।

যাইহোক, আমি একটু দেখে শুনে ‘ইজি লাইফ’ অ্যাপ থেকে আমি পাঁচ লাখ টাকার একটা ইন্সুরেন্স পলিসি নিলাম।  আমার আরও বেশি নেয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ভাগ্য ভালো বলতে হবে, নিলে এখন ক্ষতির পরিমাণটা আরও বেশি হত। আল্লাহ বাঁচাইছে।

আমি পলিসি নিয়েছিলাম ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে। ইজিলাইফ অ্যাপটাতে দেখাচ্ছিল, আমার পরবর্তী প্রিমিয়ামের তারিখ অক্টোবর ৩১, ২০২৪। প্রিমিয়াম পরিশোধের ব্যাপারে আর কিছু লেখা নেই। যেহেতু বছরে একবার প্রিমিয়াম দিতে হবে, তাই ভাবলাম অক্টোবর ৩১, ২০২৪ তারিখের পর এক বছরের মধ্যে যে কোনো সময় প্রিমিয়াম দেয়া যাবে।

আজ ১ ডিসেম্বর ২০২৪ সকাল ৬টায় মনে হল, প্রিমিয়ামটা দিয়ে দিই। দিতে গিয়ে দেখলাম, আমার পলিসি বাতিল হয়ে গেছে, এবং বলা হচ্ছে, নতুন পলিসি কিনে গার্ডিয়ান লাইফ ইন্সুরেন্সের সাথে থাকতে। আমি ভাবলাম, কোনো টেকনিক্যাল সমস্যা হয়ত। কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিলাম। এদের ওভারসিজ নাম্বারটাতে কল করলে রিং হয় কিন্তু কেউ ফোন ধরে না। তারমানে দেশের বাইরে থেকে কোনো গ্রাহক ফোন দিলে এদের পাবে না। পরে ওদের ১৬৬২২ এই নাম্বারটাতে ফোন দিলাম। কাস্টমার কেয়ার থেকে যেটা বলা হল সেটা শুনে আমি হাসব নাকি কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। কাস্টমার কেয়ারের জাহিদুলের বক্তব্য হল, ইজিলাইফ থেকে যে পলিসি কেনা হবে, সেগুলোর প্রিমিয়াম নির্ধারিত দিনের (আমার ক্ষেত্রে সেটা অক্টোবর ৩১, ২০২৪) পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে দিয়ে দিতে হবে। না দিলে, পলিসি তামাদি হয়ে যাবে, এবং অনলাইনে খোলা হয়েছে বলে এই পলিসি আর পুণরায় চালু করার সুযোগ নেই।

এখানে বলে রাখি, নভেম্বর ৪, ২০২৪ তারিখে গার্ডিয়ান লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে আমাকে কল করে বলা হয়েছিল, আমার পলিসির প্রিমিয়াম দেয়ার সময় হয়েছে কবে দেব। আমি বলেছিলাম, কিছুদিনের মধ্যেই দিয়ে দেব। তখন আমাকে বলা হয়নি যে এই পলিসির ক্ষেত্রে ৩০ নভেম্বর ২০২৩-এর মধ্যে পলিসি চালু করার একটা বাধ্যবাধকতা আছে। এবং যেই অ্যাপ থেকে পলিসি সংক্রান্ত সব তথ্য পাওয়া যায়, সেখানেও এব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই।

পলিসি কেনার আগে আমি যখন কোম্পানির প্রতিনিধির সাথে কথা বলেছিলাম, তখন আমাকে জানানো হয়েছিল, প্রিমিয়াম না দেয়া হলে পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে লেট ফি দিয়ে প্রিমিয়াম শোধ করে পলিসি সক্রিয় করতে কোনো অসুবিধা হবে না। সমস্যা হওয়ার পর কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধিকে যখন এটা বললাম তখন তিনি উত্তর দিলেন, তাদের রিটেইল প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এরকম, কিন্তু অ্যাপের মাধ্যমে যেগুলো বিক্রি করে সেগুলোর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। কিন্তু এই ভিন্নতার কথা বেশ কয়েকবারের কমিউনিকেশনে কখনই জানানো হয়নি।

স্বাভাবিকভাবেই খুব বিরক্ত হলাম। এগ্রিমেন্ট বের করলাম, দেখলাম সত্যিই এরকম একটা কন্ডিশন আছে এগ্রিমেন্টের তিন নম্বর পাতায়, খুব ছোট ছোট অক্ষরে লেখা। কিন্তু তাদের ওয়েবসাইট, অ্যাপ কোথাও এই জরুরি ব্যাপারটার উল্লেখ নেই, এবং কোম্পানির প্রতিনিধিরা বেশ কয়েকবার নানান কারণে সময়ে অসময়ে কল করলেও এই জরুরি ব্যাপারটা জানিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি।

আমার নির্ধারিত ৩০ দিনের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে ৩০ নভেম্বর ২০২৪ রাত ১২টায়। আমি প্রিমিয়াম দেয়ার চেষ্টা করেছি এর ৬-৭ ঘন্টা পরে। ব্যাপারটা উল্লেখ করে, এক্ষেত্রে কোনো আবেদন করার সুযোগ আছে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করতেই কাস্টমার কেয়ারের প্রতিনিধি বললেন, এক সেকেন্ড পরে হলেও সম্ভব নয়। এদিকে তারা নিয়মের ক্ষেত্রে কঠোর, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গ্রাহককে অবহিত রাখা যে তাদেরই দায়িত্ব সেটার ব্যাপারে তাদের উত্তর, “বিষয়টির জন্য আন্তরিকভাবে দু:খিত”। তাদের দু:খের ফলাফল আমার ৩২৪০টাকার ক্ষতি। তাও ভালো অল্পের উপর দিয়ে গেছে। বাংলাদেশের একটা বিরাট সমস্যা হল, আমরা ‘অল্পের উপর দিয়ে গেলেই’ খুশি হয়ে যাই। অবশ্য আর কিছু আশাও করা যায় না।

সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, গ্রাহককে সেবা দেয়ার যে নানান নিয়ম কানুন দেখিয়ে গ্রাহকের প্রিমিয়াম ফেরত না দেয়াই এদের প্রধান ব্যবসা। বলতে বাধ্য হচ্ছি। আমি বেচে থাকতেই এরা হাইকোর্ট দেখায়, আমি মরে গেলে আমার পরিবার ইন্সুরেন্সের টাকা পাবে এটা আশা করতে পারছিনা আসলে।

এগ্রিমেন্টটা পড়ার সময় আরও কয়েকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। কোনো এক্সিডেন্ট ঘটলে ইন্সুরেন্স ক্লেইম করতে হবে ৩০ দিনের মধ্যে।  কাছের মানুষ মারা গেলে সে যে মারা গেছে এটা বুঝতেই এক মাস পেরিয়ে যায়। এরমধ্যে একটা শোকে মুহ্যমান পরিবার ইন্সুরেন্স ক্লেইম করা নিয়ে কতটা সচেতন থাকবে সেটা একটা প্রশ্ন। একই কথা পার্মানেন্ট ডিজ্যাবিলিটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পরিজন গুরুতর অসুস্থ মানুষটার চিকিৎসা নিয়ে দৌড়াবে নাকি ইন্সুরেন্স কোম্পানির অফিসে দৌড়াবে?

আরেকটা মজার ব্যাপার। আমার পলিসির মেয়াদ ছিল ২৫ বছর। একটা কন্ডিশন দেখলাম, ইন্সুরেন্স ক্লেইম করার জন্য এগ্রিমেন্টটা জমা দিতে হবে অফিসে। ২৫ বছরের লম্বা সময়ে যদি প্রেসে ছাপা এই এগ্রিমেন্টের কাগজ কোনো কারণে নষ্ট হয় বা হারিয়ে যায়, তাহলে এফিডেভিট, অ্যাপ্লিকেশন এগুলো দিয়ে আবার এগ্রিমেন্ট তুলতে হবে। তারা প্রোডাক্ট বেচবে ডিজিটালি, কিন্তু ক্লেইম আসলে এ্যাগ্রিমেন্টের থাকতে হবে এনালগ। ইন্টারেস্টিং।

যাই হোক, আমি তো ধরা খেলাম। আপনারা এই কোম্পানির সাথে কোনো এগ্রিমেন্টে গেলে সাবধানে থাকবেন। ভালো থাকবেন।

Author: Moheul I Mithu

মহিউল ইসলাম মিঠু কৌতুহলী মানুষ। জানতে ভালোবাসেন। এজন্যই সম্ভবত খুব অল্প বয়সেই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। পড়ার অভ্যাসটাই হয়তো ধীরে ধীরে লেখার দিকে ধাবিত করেছিল। তার পাঠকপ্রিয় অনুবাদ গুলোর মধ্যে রয়েছে: দি হবিট, দি লর্ড অফ দ্য রিংস, পার্সি জ্যাকসন, হার্ড চয়েসেজ, দি আইস ড্রাগন, লিজিয়ন, প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে, দি আইভরি চাইল্ড ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রথমসারির জাতীয় পত্রিকা, সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইটের জন্য লিখেছেন বিভিন্ন সময়। তিনি বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন কিশোর-ম্যাগাজিন ‘আজবদেশ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। বিশ্বখ্যাত ২০টির বেশি বই অনুবাদ করে বিভিন্ন স্তরের পাঠকের আস্থা অর্জন করেছেন, জিতে নিয়েছেন ভালোবাসা। তার অনুদিত কিছু বই বিভিন্ন সময় জাতীয় বেস্ট-সেলারের তালিকাগুলোতে ছিল। (লিখেছেন: লে: কর্নেল রাশেদুজ্জামান)

Share This Post On

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link
Powered by Social Snap