অ্যানিমেল ফার্ম – জর্জ অরওয়েল (প্রথম অধ্যায়)

২০২৫ সালের বাংলাদেশ এমন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যে পরিস্থিতির কথা ভাবলে আমার বারবার যে বইটার কথা মনে পড়ে যায় সেটা হল জর্জ অরওয়েলের “অ্যানিমেল ফার্ম”। আড্ডার সময় প্রসঙ্গ আসায় ঋদ্ধ প্রকাশকের প্রকাশক প্রিয় ছোটভাই নেওয়াজ নাবিদ এবং সালেহ আহমেদ মুবিনকে ব্যাপারটা বলা হয়েছিল। ওরা উত্‌সাহ দিল, আমারও ইচ্ছা ছিল। দুয়ে মিলে অনুবাদ করে ফেললাম জর্জ অরওয়েলে ক্লাসিক পলিটিক্যাল স্যাটায়ার “অ্যানিমেল ফার্ম”। নিজের ভাষায় বলতে গিয়ে যেটা সবচেয়ে বেশি চেষ্টা ছিল সেটা হল বইয়ের মূলকথার সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা। কোনোভাবেই দূরত্বটা যেন বেড়ে না যায়, অ্যানিমেল ফার্মের সহজ উপস্থাপনের ফাঁক গলিয়ে মানুষের চিরন্তন রাজনৈতিক বেদনাটা যেন বেরিয়ে না যায়। একটা কথা খুব ঘটা করে বলা হয়, জর্জ অরওয়েল ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ লিখেছেল একটা বিশেষ দেশের বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, ব্যঙ্গ যতটা না করেছেন, তার চেয়ে প্রশ্ন করেছেন বেশি। তিনি আসলে সারা পৃথিবীর সকল সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক বেদনা তুলে এনেছেন এই সহজ গল্পে। এত বেদনা যে এত সহজ করে বলা যায়, এই ব্যাপারটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে। এই প্রসঙ্গ নিয়ে একদিন অনেক লিখব। এখন অনুবাদটা কেমন হল, সেটা একটু পড়ে দেখুন। ওয়েবসাইটে কমেন্ট সেকশনে বা ইনবক্সে বা ইমেইলে জানাতে পারেন কেমন লাগলো। জানতে ভালো লাগবে।

– মহিউল ইসলাম মিঠু (অনুবাদক, অ্যানিমেল ফার্ম)

অ্যানিমেল ফার্ম (প্রচ্ছদ)

ম্যানর ফার্মের মালিক মিস্টার জোনস সেরাতের মতো মুরগির ঘরের দরজা বন্ধ করল। কিন্তু লোকটা এমন পাঁড় মাতাল হয়ে ছিল যে মুরগির ঘরের ছোট ছোট ঝাঁপিগুলো (পপ-হোল) বন্ধ করতে বেমালুম ভুলে গেল। টলতে টলতে যখন উঠোনটা পার হচ্ছিল তখন হাতের লণ্ঠনটাকে ঘিরে তৈরি হওয়া আলোর বৃত্তটা একবার এদিক, আরেকবার ওদিক, দুলছিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পায়ের জুতা লাথি মেরে ছুড়ে ফেলে, রান্নাঘরের ব্যারেল থেকে দিনের শেষ গ্লাস বিয়ারটা ঢেলে নিয়ে, কোনোমতে বিছানা পর্যন্ত পৌঁছলো লোকটা। যেখানে নাক ডাকছে মিসেস জোনস।

শোওয়ার ঘরের বাতি বন্ধ হতেই গোটা ফার্মে হুটোপুটি আর ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুরু হয়ে গেল। দিনের বেলা পুরো ফার্মে একটা খবর চাউড় হয়েছে। খামারের বুড়ো সাদা শুয়োর, নাম মেজর, একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে, এবং এই স্বপ্নটার কথা সে খামারের বাকি সবাইকে জানাতে চায়। এই জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে, মিস্টার জোনস বিদায় নিলে, তারপর সবাই খামারের বড় গোলাঘরে সমবেত হবে। বুড়ো মেজরকে ফার্মের প্রত্যেকে খুবই সম্মান করে (তাকে মেজর নামে ডাকা হলেও প্রদর্শনীর সময় তাকে ‘উইলিংটন বিউটি’ নামে অংশগ্রহণ করানো হত)। তাই সবার প্রিয় ও সম্মানিত মেজরের কথা শোনার জন্য এক ঘণ্টার ঘুম বিসর্জন দিতে কারোরই আপত্তি ছিল না।

বড় গোলাঘরের এক প্রান্তে একটা উঁচুমতো প্লাটফর্ম, মেজর সেখানে তার খড়ের বিছানো বিছানায় আসীন হয়েছে। তার মাথার ওপর বিমের সাথে ঝোলানো একটা লণ্ঠন। মেজরের বয়স বারো, বয়সের কারণে আগের সেই ছিপছিপে শরীরটা আর নেই, কিন্তু তাই বলে সৌন্দর্য কমেনি। এখনও সে খুবই সুন্দর একটা শূকর। সাথে তার জ্ঞানী এবং হাস্যজ্জ্বল ভঙ্গি, কখনও না কাটা দাঁতগুলো সত্ত্বেও, তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খামারের সবাই যে যার মতো সমবেত হতে শুরু করল। প্রথমে আসলো তিনটি কুকুর, ব্লুবেল, জেসি আর পিনশার। তারপর এলো শূকরেরা, তারা মেজরের মঞ্চের একদম সামনে খড় বিছানো জায়গাটায় আরাম করে বসল। মুরগিগুলো বসল জানালার নিচের কার্নিশে, কবুতরগুলো জায়গা নিল ছাদের কড়িবর্গায়। ভেড়া আর গরুগুলো শূকরদের পেছনে বসে জাবর কাটতে লাগল। কার্টের দুই ঘোড়া বক্সার এবং ক্লোভার একসাথে আসলো দুলকিচালে, তারপর খুব সাবধানে বসল যাতে খড়ের মধ্যে থাকা কোনো ছোট প্রাণী তাদের বিশাল খুড়ের গুতোয় আঘাত না পায়। ক্লোভার হলো মমতাময়ী সুঠামদেহী মাদি ঘোড়া, কিন্তু এই মধ্যবয়সে এসে চতুর্থ বাচ্চাটা জন্ম দেয়ার পর যৌবনের সেই ফিগার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। অন্যদিকে বক্সার বিশাল, একাই দুই ঘোড়ার সমান শক্তি রাখে শরীরে। কিন্তু ওর নাকের ওপর সাদা দাগটা একটা বোকা বোকা ভাব এনে দিয়েছে চেহারায়। চেহারার সাথে মিল রেখেই খুব একটা চালাক-চতুর বলা যাবে না বক্সারকে, কিন্তু চারিত্রিক দৃঢ়তা আর কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতার কারণে সবাই তাকে সম্মান করে। ঘোড়াদের পরে এলো সাদা ছাগল, নাম মুরিয়েল, আর গাধা, নাম বেনজামিন। ফার্মের সবচেয়ে বয়স্ক আর বদমেজাজি হলো এই বেনজামিন। সে কথা বলে কম, যাও বলে সেগুলোও বেশ পাগলাটে। এই যেমন–মাঝে মাঝে তাকে বলতে শোনা যায়, ঈশ্বর তাকে লেজ দিয়েছেন মাছি তাড়াবার জন্য কিন্তু আর ক’দিন বাদেই না থাকবে লেজ, না থাকবে মাছি। এই ফার্মে বেনজামিনই একমাত্র যাকে কেউ কখনও হাসতে দেখেনি। যদি কেউ এ ব্যাপারে তাকে কিছু বলে বা কোনো প্রশ্ন করে, সে স্বভাবজাত উদাস ভঙ্গিতে বলে, হাসার মতো কিছু ঘটেনি। যাইহোক, স্বীকার না করলেও বেশ বোঝা যায়, বক্সারকে সে বেশ পছন্দ করে। দুজন মাঝে মাঝে তাদের রবিবারগুলো একসাথে ফলের বাগানের ওপারের খোলা চারণভূমিতে একসাথে কাটায়, পাশাপাশি চড়ে বেড়ায় কিন্তু কেউ কোনো কথা বলে না।

ঘোড়ার পর এলো একদল হাঁসের বাচ্চা। মা হারিয়ে বাচ্চাগুলো বসার জন্য একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছিল যেখানে বসলে অন্য কেউ তাদের মাড়িয়ে দেবে না। তাদের ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ক্লোভার তার সামনের পা এগিয়ে দিয়ে তাদের চারপাশে একটা দেয়ালের মতো তৈরি করে দিল, হাঁসের বাচ্চাগুলো বসল সেখানে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেদের অজান্তেই ঘুমিয়েও পড়ল। একেবারে শেষ মুহূর্তে ঢং করতে করতে এলো সাদা রঙের সুন্দরী আর মাথামোটা মাদি ঘোড়া মলি। জোনস সাহেবের ছোট্ট দু’চাকার গাড়িটা টানে সে। একটা চিনির দলা চাবাতে চাবাতে একেবারে সামনের দিকে গিয়ে বসল। তার ঘাড়ের লম্বা লম্বা কেশরগুলো লাল ফিতে দিয়ে সাজানো। মলি বেশ কায়দা করে ঘাড়ের সেগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল যাতে সবার নজরে আসে। সবার শেষে আসলো গোলগাল বিড়ালটা, বরাবরের মতোই চারপাশে তাকাতে লাগল সবচেয়ে উষ্ণ জায়গাটার খোঁজে। শেষে বক্সার আর ক্লোভারের মাঝে নিজেকে ঠেসে দিয়ে আরামে গরগর করতে লাগল। পুরো সময়ে আরামের আতিশয্যে মেজরের একটা কথাও তার কান দিয়ে ঢুকল বলে মনে হলো না।

এভাবে ফার্মের সবাই এসে গেল, শুধু মোজেস বাদে। মিস্টার জোনসের পোষা কাক। সে পেছনের দরজার একটা পাল্লায় ঘুমাচ্ছিল। শেষমেশ মেজর লক্ষ করল, সবাই যার যার জায়গায় বসেছে, মনোযোগ সহকারে অপেক্ষা করছে তার বক্তব্য শোনার জন্য। তখন সে খাকারি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলতে শুরু করল,

“কমরেডস, তোমরা তো ইতোমধ্যেই শুনেছো, কাল রাতে আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু সে কথায় পরে আসছি। তার আগে একটা অন্য কথা বলি। ভাইসব, আমার মনে হয়, আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। খুব বেশিদিন হয়তো আমি আর তোমাদের মাঝে থাকব না। মৃত্যুর আগে আমার অর্জিত জ্ঞানভান্ডার তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাওয়া কর্তব্য বলে মনে করি। এই সুদীর্ঘ জীবনে আমার খুপরি ঘরে একা একা শুয়ে শুয়ে আমি অনেক ভাবনাচিন্তা করার সময় সুযোগ পেয়েছি। তাই এ কথা আমি বলতেই পারি যে, এই পার্থিব জীবন আর পৃথিবীতে বসবাসকারী যে কোনো প্রাণীর ব্যাপারে আমার বেশ ভালো ধারণা হয়েছে। এসব নিয়েই আমি আজ বলতে চাই তোমাদের।

“এখন, কমরেডস, তোমরাই বলো এ কী ধরনের জীবন আমাদের? চলো সত্যিটা মেনে নিই, খুব শোচনীয়, করুণ আর ছোট একটা জীবন আমাদের। আমরা জন্মাই, তারপর আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যৎসামান্য খাবার দেয়া হয়, এরপর আমাদের মধ্যে যারা সক্ষম তাদেরকে শরীরের শেষ শক্তিবিন্দু পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয়। আর যখন আমাদের সেই শক্তিটুকুও থাকে না, যখন আমরা আর কোনো কাজের থাকি না, তখন চরম নিষ্ঠুরতার সাথে জবাই করে ফেলা হয়। এই ইংল্যান্ডের প্রতিটা প্রাণী জন্মের এক বছরের মধ্যে ভুলে যায় সুখ আর অবসব কী। এই ইংল্যান্ডের একটা প্রাণীও স্বাধীন নয়। প্রতিটা প্রাণীর জীবন দাসত্ব আর করুণার, এটাই সোজাসাপ্টা সত্য।

“কিন্তু এটাই কি প্রকৃতির নিয়ম? এই মাটি কি এতই বন্ধ্যা যে এর ওপর বসবাস করা প্রত্যেকের জন্য একটা সম্মানজনক জীবন দিতে পারে না? না, একদম না, হাজারবার না। এই ইংল্যান্ডের মাটি উর্বর, এত উর্বর যে এই মাটিতে এখন যত প্রাণী বসবাস করে এর চেয়েও হাজারগুণ বেশি সংখ্যক প্রাণী থাকলেও অসুবিধা হতো না। আমাদের এই ছোট্ট ফার্মটাতেই এক ডজন ঘোড়া, গোটা বিশেক গরু, আর শত শত ভেড়া খুব সম্মানজনকভাবে জীবনযাপন করতে পারত, যে জীবন এখন আমাদের কাছে কল্পনার চাইতেও বেশি কিছু। তাহলে তোমরা প্রশ্ন করতে পারো, আমাদের জীবন এত করুণ কেন। এত করুণ কারণ আমাদের পরিশ্রমের সব ফসল মানুষ আমাদের কাছ চুরি করে নিয়ে যায়। কমরেড, এই হলো তোমাদের প্রশ্নের উত্তর। এক কথায় বললে, উত্তরটা হলো–মানুষ। মানুষ আমাদের আসল শত্রু। যদি কোনোভাবে মানুষদের সরিয়ে দেয়া যায় তাহলে ক্ষুধা, অতিরিক্ত শ্রম আর করুণ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে, চিরদিনের মতো।”

“মানুষ একমাত্র প্রাণী যারা কিছু উৎপাদন করে না, শুধু নেয়। তারা না দেয় দুধ, না পাড়ে ডিম, এমন দুর্বল যে লাঙলও টানতে পারে না, খরগোশ ধরবে এমন দ্রুত দৌড়াতেও পারে না। কিন্তু তারপরেও সব প্রাণীর প্রভু সেজে বসে আছে। প্রভু সেজে সবাইকে কাজে লাগিয়ে দেয়, সেই কাজের বিনিময়ে যৎসামান্য খাবার আর বিশ্রামের সুযোগ দেয় যাতে প্রাণীরা মরে না যায়, বাকি সব রেখে দেয় নিজের কাছে। আমরা পরিশ্রম করে জমি চাষ করি, আমাদের গোবর দিয়ে জমি উর্বর হয়, কিন্তু তারপরেও আমাদের কেউ উৎপাদনের তুলনায় কিছুই পায় না। এই যে গাভীরা, তোমরাই বলো, শুধু গত এক বছরে কত হাজার গ্যালন দুধ দিয়েছো তোমরা। এত দুধ কোথায় গেল, যে দুধে অসংখ্য বাছুর সুঠাম হয়ে উঠতে পারত, সেই দুধ কোথায়? প্রতি ফোঁটা দুধ শত্রুর গলা দিয়ে নেমেছে। তারপর মুরগিরা, কতগুলো ডিম দিয়েছো শুধু গত এক বছরে, এরমধ্যে কতগুলো থেকে বাচ্চা হয়েছে? কয়েকটা বাদে বাকি সব তো বাজারে নিয়ে বিক্রি করা হয়েছে যাতে জোনস আর তার লোকজন টাকা পায়। আর ক্লোভার, বলো, তোমার চারটা বাচ্চা কোথায়। এই বাচ্চাগুলো কি তোমার বার্ধক্যের অবলম্বন হতে পারত না? এর বছর বয়স হওয়ার আগেই প্রত্যেকটাকে বেচে দেয়া হয়েছ। এদের একজনকেও আর কোনোদিন দেখতে পাবে না তুমি। এই যে আমাদের এত ত্যাগ, এত পরিশ্রম, এসবের বিনিময়ে কী পাই আমরা? সামান্য কিছু খাবার আর থাকার একটুখানি জায়গা?”

“এমনকি এই যে আমার চরম করুণ জীবন, সেটাও পুরোপুরি বাঁচতে দেয়া হয় না আমাদের। আমার কথা বলছি না, আমি অল্প কয়েকটা ভাগ্যবানদের একজন। বারো বছর বেঁচেছি, চারশোর বেশি বাচ্চা জন্ম দিয়েছি। কিন্তু কোনো প্রাণী শেষপর্যন্ত ছুরির নিচে পড়া থেকে রক্ষা পায় না। এই যে আমার সামনে সুন্দর সুন্দর শূকরছানারা বসে আছো, এক বছরের মধ্যে তোমরা জবাইয়ের জায়গায় দেখতে পাবে নিজেদের। একই ঘটনা ঘটবে প্রতিটা গরু, মুরগি, ভেড়ার জীবনে, প্রত্যেকের জীবনে। এমনকি ঘোড়া আর কুকুররাও রক্ষা পাবে না। এই যে, বক্সার, যেদিন তোমার গায়ের জোর শেষ হয়ে যাবে, সেদিন তোমাকেও তুলে দেয়া হবে কসাইয়ের হাতে। সেই কসাই তোমাকে কেটে সিদ্ধ করে ফক্সহাউন্ডের খাবার বানাবে। আর কুকুরদের যখন বয়স হয়ে যাবে, দাঁত পড়ে যাবে, জোনস তাদের গলায় ইট বেঁধে পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে দেবে।”

“তাহলে, কমরেড, আমরা কি বলতে পারি না যে আমাদের জীবনে যা কিছু খারাপ ঘটে তার কারণ মানুষের অত্যাচার? একবার যদি আমরা নিজেদের মানুষের কবল থেকে বের করে আনতে পারি, তাহলে আমাদের পরিশ্রমের সব ফসল আমাদের থাকবে। বলতে গেলে রাতারাতি আমরা ধনী হয়ে যাব, স্বাধীন হয়ে যাব। তাহলে এখন আমাদের কর্তব্য কী? হাড়-মাংস এক করে দিনের পর দিন পরিশ্রম করা বন্ধ করে মানুষকে গদিছাড়া করা। তোমাদের প্রতি এটাই আমার বার্তা, কমরেড। বিদ্রোহ! আমি জানিনা কবে আসবে এই বিদ্রোহ। হতে পরে এক সপ্তাহের মধ্যে, হতে পারে শত বছর পরে। কিন্তু আমি জানি বিদ্রোহ আসবেই। আমার পায়ের নিচের এই খড় যেমন সত্য, এই বিদ্রোহও তেমন সত্য। একদিন না একদিন সুবিচার আসবেই। কমরেড, সবাই সেই শুভদিনের অপেক্ষা করো। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমার এই বার্তা তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিও। যাতে তারা এই বিদ্রোহের আলোকবর্তিকা বহন করে, বিজয় না আসা পর্যন্ত।”

“আর একটা কথা মনে রেখো, কমরেড, কোনো কিছু যেন তোমাদের এই পথ থেকে সরিয়ে না ফেলে। কোনো যুক্তি যেন তোমাদের বিপথে না নিয়ে যেতে পারে। যখন ওরা বলবে, মানুষ আর প্রাণীদের স্বার্থ এক, একজনের উন্নতি মানেই অপরের উন্নতি, ভুলেও এই গপ্পো বিশ্বাস কোরো না। সব মিথ্যা। মানুষ শুধু নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কারও স্বার্থ দেখে না। এই বিশ্বাসে সকল প্রাণীকে এক থাকতে হবে। সব মানুষ আমাদের শত্রু। সব প্রাণী সহযোদ্ধা।”

বক্তৃতার এই পর্যায়ে উপস্থিত শ্রোতাদের বিরাট এক হইহুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। মেজর যখন কথা বলছিল তার মধ্যে চারটি ইঁদুর গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে কথা শুনছিল। হঠাৎ কুকুরগুলোর দৃষ্টি গেল ওই ইঁদুরগুলোর দিকে। কোনোমতে সাঁই করে গর্তের মধ্যে ঢুকে নিজেদের প্রাণ রক্ষা করল ইঁদুরের দল। সামনের পা উঁচিয়ে হই হট্টোগোল থামাল মেজর।

“কমরেড, এই ব্যাপার এখনই সুরাহা হওয়া দরকার। এই যে বন্য প্রাণী, যেমন ইঁদুর, খরগোশ–এরা কী হবে? বন্ধু নাকি শত্রু? চলো, এখনই একটা ভোট হয়ে যাক! সম্মানিত উপস্থিতির কাছে আমি প্রস্তাব উত্থাপন করছি: ইঁদুরদের কি সহযোদ্ধা বলা যায়?”

তড়িৎ গতিতে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করা হলো। বিরাট ব্যবধানে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল যে ইঁদুররাও এই আন্দোলনের সহযোদ্ধা। বিপক্ষে ভোট পড়েছিল চারটা। তিন কুকুর আর বিড়ালের ভোট ছিল প্রস্তাবের বিপক্ষে। পরবর্তীতে জানা গেল বিড়াল দুই পক্ষেই ভোট দিয়েছিল। মেজর বলে চলল:

“আর অল্প কিছু কথা বাকি আছে আমার। আবার স্পষ্টভাবে বলতে চাই, সবসময় মনে রাখবে, মানুষ আর তাদের নিয়মকানুরে বিরোধীতা করাই হবে তোমাদের দায়িত্ব। মনে রাখবে, দুই পায়ে যারা হাঁটে তারা সবাই শত্রু। আর যারা চারপেয়ে আর ডানাওয়ালা, সবাই বন্ধু। আরও মনে রাখবে, মানুষের সঙ্গে অস্তিত্বের এই লড়াইয়ে, আমরা যেন কোনোভাবেই মানুষের মতো হয়ে না যাই, তাদের আদব-কায়দা, নিয়ম-কানুন অনুসরণ করতে শুরু না করি। এমনকি মানুষকে হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করার পরেও যেন আমরা মানুষের মতো আচরণ না করি। কোনো প্রাণী কখনও কোনো বাড়িতে বসবাস করবে না, বিছানায় ঘুমোবে না, জামা-কাপড় পরবে না, মদ কিংবা তামাক ধরবে না, টাকা-পয়সায় হাত দেবে না, কোনোরকম ব্যবসা বা বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় জড়াবে না। মনে রাখতে হবে, এ সবকিছু মানুষের তৈরি মন্দ সমাজ ব্যবস্থা। আর সবচেয়ে বড় কথা কথা হলো, খেয়াল রাখতে হবে পশুরা কখনও অপরের ওপর অত্যাচার করবে না। সবল কিংবা দুর্বল, চালাক কিংবা বোকা— আমরা সবাই ভাই-ভাই। এক পশু কখনও যেন আরেক পশুকে হত্যা না করে। পশুরা সবাই সমান। ”

“এবার বন্ধুগণ, আমার গতরাতের স্বপ্নের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সেই স্বপ্নের কথা তোমাদের কতটা গুছিয়ে বলতে পারব জানি না। পৃথিবী থেকে যখন মানুষ নামক এই ত্রাসের রাজত্ব দূর হয়ে যাবে তখন পৃথিবী যেমন হবে, সেটাই দেখেছি আমার স্বপ্নে। স্বপ্নের মধ্যে অনেক দিন আগে ভুলে-যাওয়া একটা কথাও মনে পড়ে গেছে। অনেক বছর আগে, তখন আমি খুব ছোট, মিষ্টি একটা শূকরছানা মাত্র, আমার মা আর তার বান্ধবীরা মিলে খুব পুরোনো একটা গান গাইত। যতদূর মনে পড়ে, মায়েরা শুধু গানের সুরটা আর প্রথম তিনটি কথা জানত। সেই ছোটবেলায় গানটা শুনতাম, এরমধ্যে গানটা আমার মন থেকে মুছেই গিয়েছিল। গতরাতে স্বপ্নের মধ্যে কীভাবে যেন সবকিছু আবার মনে পড়ে গেল। তার চেয়েও বড় কথা হলো, শুধু সুর বা প্রথমটুকু নয় পুরো গানটাই যেন কেউ স্বপ্নের মধ্যে শুনিয়ে গেল আমাকে। আমি নিশ্চিত, অনেক অনেক কাল আগে পশুরা গাইত এই গান। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকে গিয়ে পশুরা সে গান ভুলে গেছে। এখন আমি তোমাদের সেই মহান গান আবার শোনাব, কমরেডস। আমি বুড়ো হয়েছি, গলাও ভেঙে গেছে, কিন্তু আমি এই গানের সুরটা তোমাদের শিখিয়ে দিতে চাই। যেন তোমরা আমার চেয়ে অনেক ভালো গাইতে পারো। গানটার নাম, ‘বিস্টস অব ইংল্যান্ড’।”

বুড়ো মেজর গলা খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করে গান ধরল। বুড়োর গলা আসলেই ভেঙে গেছে, কিন্তু খনখনে গলায় যা গাইলে তাও যথেষ্ট ভালো। খুব প্রেরণাদায়ক একটা সুর, ‘ক্লেমেনটাইন’ আর ‘লা কুকাচারা’ এই দুইয়ের মাঝামাঝি একটা সুর। আর কথাগুলো এমন:

ইংল্যান্ডের পশু সব, আয়ারল্যান্ডের পশু সব
আর যত চারপেয়ে আছিস এই ধরাময়,
দিয়ে মন শোন মোর নতুন দিনের গান
আসবেই ফিরে আবার সোনালি সময়।
আজ হোক নয় কাল আসবে শুভদিন
অত্যাচারী মানবকে শুধতেই হবে ঋণ
ইংরেজ ভূমির সুফলা প্রান্তর যে হায়
হবেই মুখরিত চারপেয়ের পদচারণায়

দাসত্বের আংটা নাকে থাকবে না আর,
পিঠের বর্মসাজ মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়।
সপাং চাবুক পড়বে না পিঠেতে আর,
লাগাম আর নাল সবেতে খাবে মরিচায়।

সাত রাজার সমান ধন সব হবে মোদের,
ভরবে গোলা, গম, ভুট্টা, খড় আর যবে।
সুস্বাদু সবজি কচি ঘাসগাছালি খাব আবার
ছোট বড় পশু সবাই সেদিন সমান হবে।

আলোয় ঝলমল হবে ক্ষেত ফসলের,
পবিত্র পানি পিপাসা করবে তৃপ্ত,
প্রাণ জুড়ানো ঘ্রাণ হবে মিষ্টি বাতাসের
সেইদিন হব মোরা এ শৃঙ্খল মুক্ত।

হাড়ভাঙা খাটুনিতে কাটে দিন সারা,
একটু বিরাম পেতে দেহ পাগলপারা।
গরু, ঘোড়া, রাজহাঁস, চলে আয় সবে,
লড়তে হবে প্রাণ দিয়ে, মুক্ত হব তবে।

ইংল্যান্ডের পশু সব, আয়ারল্যান্ডের পশু সব
আর যত চারপেয়ে আছিস এই ধরাময়,
দিয়ে মন শোন মোর নতুন দিনের গান
আসবেই ফিরে আবার সোনালি সময়।

  গানের কথা আর সুর উপস্থিত সবাইকে উৎসাহ উদ্দীপনার তুঙ্গে নিয়ে গেল। মেজরের গান গাওয়ার শেষের দিকটাতে লক্ষ করা গেল, সবাই নিজেরাই অন্তস্থল থেকে সেই গান গাইছে। দেখা গেল সবচেয়ে বোকা প্রাণীটাও সুরটা ধরে ফেলেছে, আর কিছু লাইনও গাইছে বাকি সবার সাথে সুর মিলিয়ে। আর কুকুর বা শূকরের মতো বুদ্ধিমান যারা তারা কয়েক মিনিটের মধ্যে গানটাকে রীতিমতো হৃদয়ঙ্গম ফেলল। তারপরেও কয়েকবার প্রস্তুতিমূলক মহড়া হলো। এরপরই পুরো ফার্মের আকাশে বাতাসে ‘বিস্টস অব ইংল্যান্ড’-এর সুর অনুরণিত হতে লাগল।

গরু নিচু স্বরে, কুকুরগুলো তীক্ষ্ণ স্বরে, ভেড়ারা সব ভ্যা-ভ্যা স্বরে, ঘোড়া হ্রেষা স্বরে, হাঁস প্যাঁক-প্যাঁক স্বরে, এরকম নানান স্বরে আসর একেবারে জ্বালাময় হয়ে উঠল। গানটা গাইতে গাইতে সবাই এতই উদ্দীপ্ত হচ্ছিল যে, পুরো গানটা পর পর একটানা পাঁচ পাঁচবার গেয়ে ফেলল। বাঁধা না পেলে হয়তো সারারাত ধরেই গাইতে থাকত।

দূর্ভাগ্যবশত, এত হই-হট্টগোলে মি. জোনসের ঘুম গেল ভেঙে। তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে পড়ল, তার ধারণা হলো খামারে বোধহয় শিয়াল ঢুকেছে। শোবার ঘরের কোনায় সবসময় একটা বন্দুক রাখা থাকে। বন্দুকটা তুলে নিয়ে তাতে ছয় নম্বর কার্তুজ ভরে অন্ধকারে ফাঁকা ফায়ার করলেন। গুলির ছররাগুলো সাঁই সাঁই শব্দ তুলে বিঁধলে গোলাঘরের দেয়ালে। সভা দ্রুত ভেঙে দেয়া হলো। প্রত্যেকে ফিরে গেল নিজের ঘুমানোর জায়গায়। পাখিরা উড়ে গিয়ে নিজেদের বাসায় পড়ল। চারপেয়েরা চুপিচুপি গিয়ে শুয়ে পড়ল নিজেদের খড়ের বিছানায়। কিছুক্ষণের মধ্যে গোটা খামারবাড়িটা যেন ঝুপ করে ঘুমিয়ে গেল।

-শেষ-

অ্যানিমেল ফার্ম প্রিঅর্ডার করে জিতে নিতে পারবেন স্পেশালি কাস্টমাইজড চাবির রিং। যারা বইয়ের থিমের উপর তৈরি করা বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করেন তাদের জন্য এটা বেশ ভালো একটা ব্যাপার হতে পারে। কারণ বাংলাদেশে এধরনের উদ্যোগ দেখা যায় না বললেই চলে।

এই চাবির রিংটি পাবেন

এব্যাপারে আরও বিস্তারিত বলেছি, এই ভিডিওতে।

Author: Moheul I Mithu

মহিউল ইসলাম মিঠু কৌতুহলী মানুষ। জানতে ভালোবাসেন। এজন্যই সম্ভবত খুব অল্প বয়সেই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। পড়ার অভ্যাসটাই হয়তো ধীরে ধীরে লেখার দিকে ধাবিত করেছিল। তার পাঠকপ্রিয় অনুবাদ গুলোর মধ্যে রয়েছে: দি হবিট, দি লর্ড অফ দ্য রিংস, পার্সি জ্যাকসন, হার্ড চয়েসেজ, দি আইস ড্রাগন, লিজিয়ন, প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে, দি আইভরি চাইল্ড ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রথমসারির জাতীয় পত্রিকা, সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইটের জন্য লিখেছেন বিভিন্ন সময়। তিনি বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন কিশোর-ম্যাগাজিন ‘আজবদেশ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। বিশ্বখ্যাত ২০টির বেশি বই অনুবাদ করে বিভিন্ন স্তরের পাঠকের আস্থা অর্জন করেছেন, জিতে নিয়েছেন ভালোবাসা। তার অনুদিত কিছু বই বিভিন্ন সময় জাতীয় বেস্ট-সেলারের তালিকাগুলোতে ছিল। (লিখেছেন: লে: কর্নেল রাশেদুজ্জামান)

Share This Post On

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link
Powered by Social Snap