গল্প: ওকানে যেওনি,বাবু

ওকানে যেওনি,বাবু

লেখক:মহিউল ইসলাম মিঠু
ধরণ: অতিপ্রাকৃত গল্প

আমি বোধহয় একবার পাহাড়ের দেবীকে দেখেছিলাম। কি বিশ্বাস হল না তো? না হওয়ারই কথা। গল্প শোনার জন্য বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তাও নিতান্তই কম। গল্পটা বরং বলি।

একবার মাঘি পূর্ণিমার সময় গিয়েছিলাম বান্দরবান। ওখানে জৌতলাং নামে একটা পর্বত আছে। অনেকের মতে সেটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। সরকারি কাগজে কলমে অবশ্য তা বলে না। আর সেটা নিয়ে কোনো কথাও বলছিনা কারণ সেটা আমাদের গল্পের জন্য অপ্রয়োজনীয়।  আমাদের মত যারা শখের বসে পকেটের টাকা খরচ করে বাংলাদেশের বনেবাদাড়ে ঘোরাঘুরি করেন, তাদের কেউ কেউ হয়ত জৌতলাং-এ গিয়েছেনও। তবে বেশিরভাগই যাননি, কারণ জায়গাটা খুব বিদঘুটে। এবং সাধারণ অর্থে অবকাশ যাপন বা হাওয়া বদলের উপযোগি বলা যায় না কোনোভাবেই।

দেশের অন্যান্য পর্বতচূড়ায় উঠতে গেলে পর্যটকরা অনেকসময় একইসাথে কয়েকটা পর্বচূড়ায় আরোহন করে ফেলেন। মানে একটা ট্রিপে গিয়ে কয়েকটা চূড়া জয় করে আসেন। কারণ সেগুলা পাশাপাশি, একযাত্রাতেই যাওয়া যায়। কিন্তু জৌতলাং তেমন নয়। অন্যান্য চূড়াগুলো থেকে আলাদা, নিঃসঙ্গ। এর কাছাকাছি আরেকটা চূড়া আছে বটে, কিন্তু সেটাতে আলাদা পথে যেতে হয়। এখানে এক ঢিলে দুই পাখি মারার অপশন নেই। দুই পাখি মারতে দুটো ঢিলই মারতে হবে।

যাই হোক, জৌতলাং-এ যেতে হলে সর্বশেষ যে জনবসতিতে রাত্রিযাপন সম্ভব তার৷ নাম দলিয়ানপাড়া। কয়েক ঘর বম জাতিগোষ্ঠীর লোকের বসবাস দেশের সর্বোচ্চ এই মানব বসতিতে। যে রাতের কথা বলছি সেটাই দলিয়ানপাড়ায় আমাদের শেষ রাত ছিল। আমাদের মানে আমার চারজন সফরসঙ্গী ও আমি। আগের দিন ভোরে আমরা জৌতলাং-এর চূড়া থেকে ফিরেছি। আমাদের একজন অবশ্য যেতে পারেনি চূড়া পর্যন্ত। মাঝ রাস্তা থেকে ফিরে এসেছিল। একটা পাহাড়ের চূড়া দেখতে এত কষ্ট করে জঙ্গলাকীর্ণ ঝিড়িপথ, পাহাড়ি বাশ বন, ঝুকিপূর্ণ পর্বতগাত্র পাড়ি দিয়ে যাওয়াটা খুব অযৌক্তিক মনে হচ্ছিল।

আগেরদিন দলিয়ানপাড়া থেকে ভোরে রওনা দিয়ে চূড়ায় উঠে আবার দলিয়ানপাড়ায় ফিরে আসতে আমাদের মত শখের পর্বতারোহীদের পরের দিন সকাল আটটা বেজেছিল। পাহাড়ি জঙ্গলে সেই নির্ঘুম বিরামহীম ট্রেকিং আমার সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে। সারারাত ট্রেকিং করতে হয়েছিল তাই ফিরে এসে নাকে মুখে কিছু সুগন্ধী চালের ভাত (স্থানীয় ভাষায় কুকড়া চল বলে। ভাতটা একটু লালচে হয়, তাতে হালকা পায়েশের মত গন্ধ থাকে। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই ধানের চাষ দেখা যায়।) খেয়ে বেঘোরে ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে সন্ধ্যা নাগাদ আমরা গেলাম একটা মারমা পাড়ায়, সেখানে  মাঘি পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে একটা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল।

পাঠকদের অনেকেই বোধহয় জানেন, মারমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আর বমরা খ্রিস্টান। সভ্য জগৎ থেকে এতদূরে দুটো আলাদা ধর্মে বিশ্বাসী আলাদা জাতিগোষ্ঠীর লোকেদের মধ্যে অসাধারণ এক সম্প্রীতি দেখে আমাদের মন ভালো হয়ে গিয়েছিল।

একটু পেছনের কথা না বললে, বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। তাই পরিপ্রেক্ষিতটা আর জায়গাটার ভৌগলিক অবস্থান নিয়ে একটু বলি। বান্দরবানের সর্বদক্ষিণের উপজেলা হল থানচি। থানচির ছোট বাজারটাতে গিয়ে দেশের সড়ক যোগাযোগ শেষ হয়ে যায়। সেই থানচি থেকে আরও ভেতরে পাহাড়ি অঞ্চলে যাওয়ার উপায় দুইটা। এক, আপনাকে হেঁটে যেতে হবে। দুই, ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকা রেমাক্রি খালে চলাচল করে, সেসব নৌকায় যেতে হবে। একদম অগভীর পানিতে চলাচলের সুবিধার জন্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ইঞ্জিন-চালিত নৌকার মত এই নৌকার প্রোপেলার নৌকার নিচে স্থায়ীভাবে বসানো থাকে না। ব্রিফকেসের মন ইঞ্জিনের সাথে লম্বা ডান্ডা লাগানো থাকে, সেই ডান্ডার মাথায় ছোট ছোট প্রোপেলার লাগানো। নৌকার চালক পানির গভীরতা অনুযায়ী প্রোপেলার ওঠানামা করায়। প্রতি নৌকায় সবমিলিয়ে পাঁচ ছয় জন যাত্রী উঠতে পারে। এইসব নৌকায় চড়ে যেতে হয় রেমাক্রি বাজার। থানচি থেকে বেশ দ্রুতগামী সেই স্থানীয় স্পিডবোট সদৃশ নৌকায় রেমাক্রিবাজার যেতে আমাদের সম্ভবত ৩-৪ ঘন্টা সময় লেগেছিল।

রেমাক্রিখালের দুপাড়ে পাহাড়ি জঙ্গল কোথাও কোথাও আকাশ ছুয়েছে। মাঝে মাঝে কালে ভদ্রে দুই একটা জুমের ক্ষেত দেখা যায়। তবে পরিমাণে খুবই কম। কিন্তু এছাড়া পুরোটাই টারশিয়ারি যুগের পর্বত। অনেক জায়গায় দুপাশের পর্বতের দেয়াল চেপে এসে উপরের উন্মুক্ত আকাশকে ফিতের মত বানিয়ে ফেলেছে। নগ্ন পর্বতগাত্রের স্পষ্ট শিলাস্তর লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাস নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। কোথাও কোথাও শিলাখণ্ড পর্বতের গা থেকে ভেঙ্গে পরে রেমাক্রিখালের পানিপ্রবাহের পথে বিরাট প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরকম একটা পর্বত থেকে খসে পড়া বিরাট শিলাখণ্ডের নাম রাজাপাথর। এই অঞ্চলে যাতায়াত আছে এমন অনেকে হয়ত শুনে থাকবেন।

পাহাড়ের নির্জনতায় ঈশ্বরের রহস্য ফিসফিসিয়ে কথা বলে। রহস্যের সেই ফিসফিসানি শুনতে শুনতে সন্ধ্যায় আমরা পৌছেছিলাম রেমাক্রিবাজার। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যখন আবার রওনা দিলাম তখন গোধূলি। সেরাতে আমরা পাহাড়ে পথ হারিয়েছিলাম। সেই হারানো গল্প হয়ত কোনোদিন বলা হবে বা বলা হবে না, তবে এখানে আর বলছিনা। পথ হারানোর পর আর কোথাও যাওয়া সম্ভব না বলে মাঝরাতে মাথা গোঁজার জন্য এক আদিবাসী গেরস্তের আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিলাম সবাই। গেরস্ত সাদরে গ্রহন করেছিলেন। একটা মাত্র ঘরের মাঝে পর্দা টাঙিয়ে আমাদের শোওয়ার জায়গা করে দিয়েছিলেন। ঘরের সবচেয়ে সুন্দর কম্বল চারটে বের করে দিয়েছিলেন আরামের জন্য। মাঝরাতে পাহাড়ি মোরগ এনেছিলেন খাওয়ানোর জন্য। এই আতিথেয়তা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।

যাইহোক, পর দিনের আলো থাকার অর্ধেকের বেশি সময় হেঁটে আমরা সেই সুহৃদ পাহাড়ি গেরস্তের বাড়ি থেকে দলিয়ানপাড়ায় পৌঁছেছিলাম।

পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন পরিচিত গ্রাম্য, শহুরে আর মফস্বলের সমাজ থেকে কতটা দূরে ওই দলিয়ানপাড়া।

গ্রাম, শহর বা মফস্বলে যারা বড় হয়েছেন তারা বুঝতে পারবেন না। আদিবাসীদের পাড়াগুলো আমাদের পরিচিত পাড়া মহল্লাগুলোর মত নয়। এখানে শত শত বাড়ি থাকে না। ৮-১০ ঘর (বা তার চেয়ে কিছু কম বেশি) নিয়ে একেকটা পাড়া গড়ে ওঠে। পাড়ার প্রধানকে ‘কারবারি’ বলে। আর কারবারির নামে পাড়ার নাম হয়। কয়েকটা পাড়া মিলে একসাথে হয় ‘মৌজা’। এই মৌজার প্রধানকে আবার বলা হয় ‘হেডম্যান’।

দলিয়ানপাড়ার প্রধান অর্থাৎ কারবারির নাম দলিয়ান বম। বছর পঞ্চাশেক বয়স। কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই। ২৫-২৬ বছরের তরুনের মত সতেজ ত্বক। ছোটখাট শরীরে মজবুত গাঁথুনি। গায়ের রঙ ফরসা। হাসলে মেদহীন গালে অনেকগুলো ভাঁজ তৈরি হয়। সেই ভাঁজ বয়সের কারণে নয়, ত্বকের নিচে একফোঁটাও বাড়তি চর্বি না থাকার কারণে। নিজেদের মধ্যে অনেক পলিটিক্স, দেনদরবার হয়ত থাকলেও থাকতে পারে, তবে আপাতদৃষ্টিতে পাড়ার সবচেয়ে চৌকষ লোকটা হন সেই পাড়ার কারবারি। আর মৌজার সবচেয়ে যোগ্য লোকটা হন সেই মৌজার হেডম্যান। দূর থেকে অনেক কিছু মনে হতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, নেতৃত্ব আর ক্ষমতার যে জটিলতা সমতলের মানুষের মধ্যে আছে। গহীন পাহাড়ের সেই মানুষগুলোর মধ্যে কিন্তু ততটা নেই। ভোর হলে নারীপুরুষ সবাই জুমচাষ করতে যায়। সন্ধ্যে হলে ফিরে এসে বিশুদ্ধ তরকারি দিয়ে দুমুঠো খেয়ে ঘুমায়। একজন নেতা দরকার তাই কারবারি বানায় একজনকে, যার উপর পাড়ার সবার আস্থা আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের চোখ থেকে এতদূরে স্বার্থ আর টাকার খেলা ততটা ইফেক্টিভ হওয়ার কথা নয়, সেটার কারণও নেই।

দলিয়ানপাড়ার কারবারি দলিয়ান বম আবার ওই মৌজার হেডম্যান। তাকে আমি কয়েকদিন দলিয়ান দাদা বলেই ডেকেছিলাম। যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়ে দলিয়ান দাদাকে এলাকার সবাই সম্মান করে, সমিহ করে চলে। সম্ভবত ভালোওবাসে। কথাবার্তায় প্রচণ্ড বিনয়ী হলেও দৃষ্টিতে প্রজ্ঞার স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। নিজের প্রশংসা শুনলে লজ্জা পান, তার পাড়া আর মৌজার মানুষের উন্নতির জন্য কি করছেন সেগুলো নিয়ে কখনও গর্ব করেন,  কখনও আফসোস।

এই মানুষটা যখন বললেন, তিনি জীবনে এক বা দুইবার মাত্র চট্টগ্রামে গেছেন। কোনোদিন ঢাকায় বা দেশের অন্য কোথাও আসেননি এবং আসার দরকারও মনে করেন না, তখন শুধু অবাক হইনি, জীবনের অন্য একটা অর্থ আমার সামনে হাজির হয়েছিল। যে গাইড আমাদের সাথে ছিল, সে জাতিতে ত্রিপুরা। সে কখনও চট্টগ্রামেও আসেনি। সবচেয়ে দূরে যে জায়গায় সে জীবনে একবার গিয়েছিল সেটা বান্দরবান জেলারই আরেকটা উপজেলা। গাইডের বয়স ছিল ৩৭। দলিয়ান দাদার পাশের পুরান একটা ঘর ছিল। সেই ঘরের দাওয়ায় এক বুড়ি রোদ পোহাতেন দিনের অর্ধেক সময়। সামান্য বাংলা বলতে পারেন তিনি, কিন্তু ঢাকা নামটা কোনোদিন শোনেননি। দলিয়ান দাদার বউকে স্মার্ট মানুষ মনে হয়েছিল। পাড়ার প্রধানের বউ যেমন স্মার্ট হওয়ার কথা তেমন। গ্রামের মেয়ে আর মহিলাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা আছে সেব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তিনি ঢাকা নামে একটা শহরের নাম শুনেছেন বটে, কিন্তু সে অন্য পৃথিবীর মত দূরে কোথাও তাই মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেননি কোনোদিন। পাঠকের যদি অবাক লেগে থাকে তাহলে বলতেই হবে, হ্যা, সেটা সত্যিই এক অন্য পৃথিবী। সেখানে ভোর হতেই পাড়ার সব বয়সী সক্ষম নারী-পুরুষ সবাই একসাথে জুমে চলে যায়। পাড়ায় থাকে শুধু বাচ্চারা আর অথর্ব বুড়োরা যারা ক্ষেতে কাজ করতে পারেনা। বিকেল গরিয়ে গেলে সবাই ফিরে আসে। রান্না করে, খায়, দু-দণ্ডের জন্য এবাড়ি ওবাড়ি যায়। গল্প গজব করে। রাত নিশুতি হওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে।

এতক্ষণ ধরে এত কিছু বলার কারণ আমাদের তথাকথিত আধুনিক সমাজ থেকেও এত দূরে দুটো আলাদা পাড়ার দুটো আলাদা জাতিগোষ্ঠীর দুটো আলাদা ধর্মের মানুষের মধ্যে কত সম্প্রীতি আর মনের যোগ থাকতে পারে সেটার একটা প্রতিচ্ছবি তৈরি করার চেষ্টা করা। আমাদের আধুনিক সভ্য সমাজেও কখনও কখনও দেখা যায় না। আরেকটা উদ্দেশ্য আছে সেটা হল, পাঠককে বোঝানো আমাদের শহুরে বা মফস্বলের সমাজের সাধারণ নিয়ম আর চিন্তাধারার গতিপথ ধরে এগোলে এই পাহাড়ি মানুষগুলোর সমাজ বা জীবন কোনোটাকেই ঠিক বোঝা যাবে না। একটু আলাদাভাবেই ভাবতে হবে।

আজকে আমার গল্প কীভাবে যেন তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প হয়ে যাচ্ছে। জীবন সংসারের কথা এসে যাচ্ছে বারবার। তারানাথের মত বলতেই হচ্ছে, গল্প বলতে শুরু করলে না চাইতেও চলে আসে এসব। কারণ গল্পগুলো তো জীবনেরই অংশ।

যাই হোক, গল্পটা শেষ করি। দলিয়ান পাড়া থেকে সেই মারমা পাড়া আধাঘন্টার হাটা পথ বা কিছু বেশিও হতে পারে। সেখানে মারমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব মাঘি পূর্ণিমার দাওয়াত পেয়েছেন দলিয়ান দাদা। ঘরে বিদেশি অতিথি রেখে দলিয়ান দাদা একা যেতে চাইলেন না। অনুষ্ঠানে তার সাথে যাওয়ার জন্য জোর করতে লাগলেন। বেশি জোরাজোরি করতে হল না কারণ এতদূরে এসে আদিবাসীদের একটা নিজস্ব উৎসব দেখার সুযোগ ছাড়তে চাচ্ছিলাম না আমি। এসবে আমি বরাবরই এক কাঠি সরেস। আমাদের পাঁচজনের টিমের দুইজন কোনোভাবেই যেতে রাজি হল না। কয়েকদিন টানা পাহাড়-পর্বত বেয়ে কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই বলে জানালো। বাকি দুইজনকে এই বলে রাজি করালাম যে, যদি বেশি দেরি হয় আমরা না হয় আগেই চলে আসব। বিকেলের পর পর রওনা দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ পৌছে গেলাম সেই মারমা পাড়ায়। গিয়ে দেখি ছোট একটা স্টেজের মত বানানো হয়েছে। স্টেজের সামনে ছেলেমেয়েদের ভীড়। মারমা, বম, ত্রিপুরা, সবই আছে। দুটো সাউন্ডবক্স আনা হয়েছে, আমাদের এদিকে বিয়ে বাড়িতে যেমন বাজে। ভীড়টাও বিয়ে বাড়ির মতই। এজন্য অনুষ্ঠানকে ছোট ভাববেন না। ওইদিকটাতে মানুষ কম, তাই এরকম একটা জমায়েতকে সে তুলনায় বেশ বড়ই বলতে হবে। একটু তুলনামূলক চিন্তা করে দেখুন, শহরের একটা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এ যত মানুষ থাকে, বান্দরবানের এত গহীনে একটা পাড়া তো দূরের কথা একটা মৌজাতেও হয়ত এত মানুষ থাকে না।

মারমা পাড়াতেও আমরা কতগুলো সামান্য মানুষ সম্মান পেলাম খুব। আমাদের তিনজন সহ বাকি সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে চেয়ারে বসানো হল। চেয়ারের কমতি ছিল বোধহয়, তুলনামূলক কমবয়সী কয়েকজন লোক উঠে গিয়ে বাকি সবার সাথে নিচে বসে আমাদের বসতে দিল। আমরা না না করেছিলাম বটে কিন্তু আমাদের কথা কেউ পাত্তাই দিল না। যারা উঠে গিয়েছিল তারাও বোধকরি সম্মানীয় গোছেরই কারণ তারা নিচে বসতেই তাদের সামনের সারিতে জায়গা করে দেয়া হল।

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছিল আমরা পৌছানোর আগেই। আমি ভেবেছিলাম হয়ত পাহাড়ি নাচ-গান দেখার সুযোগ হবে। কিন্তু সেরকম কিছু হল না। কলকাতার বাংলা গানের সাথে নাচল যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীরা। বেশ কয়েকটা পারফর্মেন্স হল। তারপর মাইকে পাহাড়িটানে বলা বাংলায় ঘোষণা এলো সুদূর চট্টগ্রাম (ঢাকা নামটা হয়ত মাথায় ছিল না কমবয়সী ছোকড়া ধরনের ঘোষকের।) থেকে আগত তিনজন সম্মানিত অতিথির জন্য ছেলেমেয়েরা একটা বিশেষ পরিবেশনা নিয়ে আসছে। আমাদের সম্মানে তিনটা তাৎক্ষণিক আয়োজিত সমবেত নৃত্য পরিবেশিত হল। তাৎক্ষণিক বুঝলাম তার কারণ দুটো। এক, আমরা যে আসব এটা ওদের জানার কথা নয়। দুই, আমরা বসে থাকা অবস্থাতেই যখন আগের নাচ চলছিল তখন দর্শকদের মধ্যে থেকে শিল্পীদের ডেকে আনা হচ্ছিল। একটা কথা বলতেই হচ্ছে, এর আগে কখনও এতটা স্পষ্টভাবে মাথায় আসেনি কিন্তু এখন লেখার সময় অনুভব করতে পারছি, বহুদূরের অচেনা সহজ সরল মানুষগুলো কী সম্মানটাই না দেখিয়েছিল সেদিন!

আমাদের সম্মানে কয়েকটা পরিবেশনার পর শিল্পীদের একজন এসে আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করল। আমাদের সম্মানে তেমন কিছু করতে পারেনি ওরা, আমরা যেন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখি ব্যাপারটা। আমরা অপ্রস্তুত হয়ে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমরা কিছু মনে করিনি। সাথে খুশি হয়ে দক্ষিণা স্বরূপ কিছু টাকা ওই শিল্পীর হাতে গুঁজে দিতে চাচ্ছিলেন আমার সঙ্গী বড়ভাইটি। কিন্তু কোনোভাবেই টাকাটা দেয়া গেল না তাকে। এরমধ্যেই আরেকজন অচেনা লোকসহ দলিয়ান দাদা আমাদের ডাকতে এলেন। আমাদের জন্য সামান্য নাস্তাপানির আয়োজন করা হয়েছে। আমরা এতসবের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তবুও মেজবানরা ডেকেছেন, যেতেই হবে।

পাশেই একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। গিয়ে দেখি আরেক কান্ড, কয়েক রকমের পিঠা, স্থানীয় খাবার দাবার অনেক পরিমানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় বাড়িগুলো মাচার উপর তৈরি করা হয়। ঘরের মেঝে হয় বাঁশের। মেঝেতেই মাদুর বিছিয়ে খাবারের আয়োজন। নতুন নতুন খাবার টেস্ট করতে আমরা তিনজনই ভালোবাসতাম। সবাই খেলাম। বাকি দুজন না না করে খেল, আমি আগ্রহ নিয়ে সবগুলো আইটেম খেয়ে দেখলাম। বিচিত্র খাবার, বন মোরগ, কচি বাঁশ, শুকরের মাংস, কচ্ছপের মাংস, অনেক পদের পাহাড়ি ফল, বেশ কয়েকরকম পিঠা, আরও কি কি যেন সব মনে নেই। খেতে খেতে জানতে পারলাম, দলিয়ান দাদার সাথে আমাদের ডাকতে যাওয়া সেই অচেনা লোকটা মারমা পাড়ার কারবারি।

খাওয়া শেষে গল্প হল কিছুক্ষণ। আমাদের সাথে আরও কয়েকজন খেতে বসেছিলেন। সবাই দলিয়ান দাদা গোছেরই হবেন। দুইজন বাংলা বলতে পারেন না। তারাও হাসিমুখে আমাদের বিভিন্ন কথা বললেন। বাকিরা বাংলায় তরজমা করে বুঝিয়ে দিল তাদের কথা। একসাথে খেলাম গল্প করলাম, একবারও মনে হল না, এই মানুষগুলোর সাথে এটাই প্রথম আর শেষ দেখা। কিছুক্ষণ পর পাহাড়ি পানীয় পরিবেশিত হল। সাথে বড় স্টিলের বাটিতে একবাটি ঝি ঝি পোকা ভাজি। স্থানীয়রা বড় বাশের গ্লাসে পানীয় ঢেলে নিলেন। আমাদের কাঁচের গ্লাসে দেয়া হল। ভদ্রতা হিসেবে আমরাও নিলাম, তবে অর্ধেক গ্লাস বা তার কম। খুশি হল সবাই। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমাদের সামনে প্রতিটা আইটেমই এগিয়ে দিচ্ছিলেন মেজবানরা। একটু ইতস্ততভাব থাকত প্রতিবারই। আমরা পছন্দ করব কিনা বা নেব কিনা। কিন্তু নিলে আন্তরিক একটা হাসি ফুটে উঠত সহজসরল চেহারায়। মন খুলে খেলে, একসাথে বসলে, মনোযোগ দিয়ে কথা শুনলেই, বোধহয় এদের কাছের মানুষ হওয়া যায়। খুব বেশি কিছু করতে হয় না। পানীয় পর্ব বেশিক্ষণ দীর্ঘায়িত হতে দিলেন না দলিয়ান দাদা, কারণ আমরা জৌতলাং-এ গিয়ে খুব ক্লান্ত, বিশ্রাম দরকার। মারমা পাড়ার মেজবানদের তাদের পানীয়র আসরে রেখেই বিদায় নিয়ে চলে আসলাম আমরা। অনুষ্ঠান ততক্ষণে শেষ হয়েছে। স্থানীয় তরুন-তরুণী কিশোর-কিশোরীরা জটলা পাকাচ্ছে।

ফেরার সময় পূর্ণিমার পূর্ণ চন্দ্রের আলোয় আলোকিত চারিদিক। আমার দুই সঙ্গীকে খুব খুশি মনে হল। দলিয়ান দাদাও খুশি। আমিও খুশি। খোশমেজাজে গল্প করতে করতে ফিরছিলাম সবাই। চাঁদের আলো সরু পাহাড়ি ছড়ায় রূপোর মত চমকাচ্ছিল। আর শিশির বিন্দু যেন একেক্টা হীরার টুকরা হয়ে গিয়েছিল। পথ খুব বেশি না হলেও কমও তো নয়, কথাবার্তা হল অনেকরকম। পথে অনেক কথা বললেন দলিয়ান দাদা। আগে কেমন অনুষ্ঠান হত, এত বাজনা ছিল না, কীভাবে গলা ছেড়ে গাইতেন সবাই। বউকে প্রথমবার কীভাবে বলেছিলেন মনের কথা। সেদিনও নাকি এমন অনুষ্ঠান ছিল। এসব অনেক পুরোনো কথায় মনের চিড়ে ভিজছিল সবার।

দলিয়ানপাড়া গড়ে উঠেছে পাহাড়ের গায়ে। পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত কম ঢালু অংশের দুইপাশে সামান্য ফাঁকা রেখে রেখে দুইসারি বাঁশের চৌচালা ঘর। সবগুলো ঘরই মাচার উপর। পাড়ায় দলিয়ান দাদার ঘরটাই সবচেয়ে বড়। পাড়ায় সবমিলিয়ে ঘর ছিল পনেরোটা। আর মাঝে একটানা উঠান ক্রমশ উঁচুতে উঠে গেছে। ঘরের সারির পেছনেই পাহাড় সোজা নেমে গেছে অনেকদূর। দলিয়ানপাড়া যেহেতু অনেক উচুতে তাই উঠানে দাঁড়ালে তিনপাশে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়।

মারমা পাড়া থেকে দলিয়ান পাড়ায় ফেরার পর আমার চক্ষু ছানাবড়া। জোছনার এমন সৌন্দর্য আমি কখনও দেখিনি। চাঁদের আলো যেন পাহাড়ি গাছের পাতা বেয়ে বেয়ে পড়ছে। আশেপাশে কোথাও জনমানব নেই। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম জোছনা ধুয়ে দিচ্ছে পৃথিবীকে। সৌন্দর্য যে মানুষকে স্তব্ধ আর বাকরুদ্ধ করে দিতে পারে সে রাতে বুঝেছিলাম। দলিয়ান দাদাও বোধহয় বুঝতে পারলেন। আমাদের নিয়ে বাড়ির সামনে বাঁশের মাচায় বসলেন কিছুক্ষণ। এর আগে প্রতিদিনই তিনি রাত হলে ঘরের বাইরে থাকতে নিষেধ করতেন। আমরা ভেবে নিয়েছিলাম, সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে থাকাটা হয়ত এখানকার অলিখিত নিয়মগুলোর বাইরে। সেদিনও বেশিক্ষণ থাকতে দেয়া হল না। হয়ত মিনিট দশ পনেরো হয়ত আমাদের নিয়ে মাচায় বসেছিলেন দাদা। তারপর অনেকটা জোর করেই ঘরে আনা হল। দলিয়ান দাদা আমাদের ঘরে রেখে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

রাত তখন আটটা মাত্র পেরিয়েছে। বাঁশের মোটা চাটাই দিয়ে বানানো বিছানায় শুয়ে আরামই লাগছিল। পাহাড়ে হাঁটাচলায় অনভ্যস্ত শরীর খুব আরাম পাচ্ছিল বটে। কিন্তু সারারাত জেগে থাকার অভ্যাস। তারমধ্যে দিনে ভালো ঘুম হয়েছে। ঘুম তো আর আসেনা। চারদিক এমন নিস্তব্ধ,  এম্নিতেই দেহমেনে শান্তি নেমে আসে।

কিন্তু বিছানায় কতক্ষণ আর চুপচাপ শুয়ে থাকা যায়। ফোনে চার্জ শেষ হয়ে গেছে চার-পাঁচ দিন আগেই। বই পড়ারও উপায় নেই। সবাই ঘুম। আর আলোও তো নেই। হারিকেনটাও নিভে গেছে। ও হ্যা, বলাই তো হয়নি, আমরা সবাই একসাথে ঘুমাতাম দলিয়ান দাদার গেস্টরুমে। এই সময় আলো জ্বালিয়ে সবার ঘুম নষ্ট করার মানে হয় না। আরও অনেক্ষণ এপাশ ওপাশ করলাম। আকাশ পাতাল ভাবলাম। কিন্তু ঘুমের রানীর পাত্তা নেই। বহুদূরে কোথাও ঘুরতে গিয়েছিল হয়ত।

কতক্ষণ এভাবে কাটল বলতে পারব না। বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লাম একসময়। নিঃশব্দে দরজা খুলে ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চাঁদ তখনও বিশ্ব চরাচর ভাসিয়ে চলেছে। বহুদূরের পাহাড়ের চেহারাও দেখা যায় স্পষ্ট। চাঁদের আলো ছাড়া আর একবিন্দু কৃত্রিম আলো নেই কোথাও।

এই সৌন্দর্য রেখে আমি ঘরে এপাশ ওপাশ করছিলাম। ব্যাপারটা ভাবতেই নিজের উপর যারপরনাই বিরক্ত লাগল। সময় তখন কয়টা বাজছিল বলতে পারব না। জানলেও খুব একটা কেয়ার করতাম না। এমন শান্তিময় স্বর্গীয় সুন্দর নীরবতায় বেঁচে থাকা উপভোগ করার চেয়ে সময়ের আরও ভালো ব্যবহার থাকা সম্ভব নয়।

বারান্দাটাও বাঁশের। মেঝে দেয়াল বারান্দার রেলিং সব বাঁশের তৈরি। খুব দামী রিসোর্টেও এমন নিখুঁত কাজ দেখা যায় না। খুব হিংসে হল৷ এই বহুদূরের মানুষগুলো সারাজীবন কী শান্তিতেই না ফাইভ স্টারের জীবন-যাপন করে। পাঁচ তারকা কম বলা হল আসলে। বারান্দায় একটা পুরোনো চকি জাতীয় কিছু ছিল। সেখানে বসলাম অনেক্ষণ। মনে হচ্ছিল ভাগ্যিস আমার সঙ্গীসাথীরা সব ঘুমিয়ে গেছে। চূড়ান্ত নীরব প্রকৃতির এই অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে প্রিয়তমার সবচেয়ে প্রিয় কথাটাও বিষের মত শোনাত।

কিছু সময় একাই ভালো। আমি তখন সেই ভালোটাকেই উপভোগ করছিলাম সর্বোচ্চ সীমায়। এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানিনা। সময়ের হিসাব রাখার উপায় ছিল না। হাতে ঘড়ি নেই। সেটা তখন ভীষণ অপ্রয়োজনীয়ও বটে।

অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে পাহাড়ের সেই আদিম অবর্ণনীয় সৌন্দর্য যেন আমাকে অস্থির করে তুলল। এ সৌন্দর্যের অনুভূতি আজকের পরে আর কোনোদিন পাওয়া যাবে না। এই প্রশান্তির মাঝে কোনোকিছু ছাড়াই এক জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। মনে হল আর ফিরতে চাই না। এখানেই থেকে যেতে পারলে ভালো হত।

জোছনার সৌন্দর্য আমাকে বারান্দার বাইরে টেনে আনল। দলিয়ান পাড়ার ক্রমশ ঢালু হয়ে যাওয়া উটের পিঠের মত উঠানে একলা দাঁড়িয়ে আমি। যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও কেউ নেই। পাড়ার পেছনে হাজার বছরের পুরোনো অরণ্য। চাঁদের আলোয় সবুজপাতা চিকচিক করছে। জোছনা যেন আলো নয় শান্ত কোনো পাহাড়ি ঢলের পানি। জলের মত চারপাশের প্রতিটা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে যাচ্ছে চাঁদের আলো। ভিজিয়ে দিচ্ছে সব কিছু। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আনন্দের আতিশয্যে একটা পাগলাটে অট্টহাসি বেরিয়ে আসতে চাইল বুক থেকে। এই হাসিকে হিস্টেরিক লাফটার বলে ইংরেজিতে। কিন্তু বহুকষ্টে চেপে গেলাম। আমার আনন্দের হাসিও এই পবিত্রতাকে দূষিত করে ফেলত। সেই সাহস আমার নেই।

চোখের সামনে কয়েকটা মাত্র ঘর। তারপরে দিগন্ত বিস্তৃত অরণ্য। কিন্তু একটা প্রানির শব্দও কানে আসল না। সবাই যেন অসীম নীরবতার পবিত্রতা আস্বাদন করছে আমারই মত। এত সৌন্দর্য আর নীরবতা অলৌকিক সঙ্গতকারণেই লাগার কথা ছিল, সহ্য করাটা কঠিন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার তা হল না। অন্যদিন হলে হয়ত হত, কিন্তু সেদিন হচ্ছিল না।

হাঁটতে হাঁটতে কখন পাড়ার বাড়িগুলো ছেড়ে নেমে এসেছি খেয়াল করিনি। পাড়ার বাড়িগুলোর সীমানা শেষ হওয়ার পর পাহাড়ের ঢাল উঠানের তুলনায় একটু বেশি খাড়া হওয়াতে সেখানে মাটিতে খাঁজ কেটে সিঁড়ির মত করা হয়েছে। এই সিঁড়িটুকু পাড় হলেই দলিয়ানপাড়ার সীমা শেষ, আদিম পাহাড়ি জঙ্গলের শুরু। এখানে জঙ্গল মানে ঝোঁপ ঝাড় আর অপেক্ষাকৃত ছোট গাছ গাছালি। এগুলোই ধীরে ধীরে গভীর অরণ্যে মিশেছে। সিঁড়ি শেষ হওয়ার পরে পায়ে হাঁটা পথটা ক্রমশ সরু হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায়  সরু পথের ধারেই শূকরের খোয়াড়। খোয়াড় থেকে একটু দূরে একটা বড় সাইজের শূকরকে বাঁশের তৈরি আলাদা খাঁচায় রাখা হয়। খাঁচাটা ওর শরীরের তুলনায় ছোট। চাঁদের আলো এত তীব্র যে খাঁচার ভেতর সেটার কালো শরীরটাও শুয়ে থাকতে দেখলাম। এই বিশালদেহী শুকরটাকে এই কয়দিনে কোনোদিন স্থির থাকতে দেখিনি। পাড়ায় ঢোকার মুখে এই খাঁচাটা। পাড়ায় ঢোকার পথে সবার আগে চোখে পড়ে। এত বড় একটা প্রাণিকে এত ছোট খাঁচায় না রেখে একটু বড় খাঁচার কেন রাখেনা সে প্রশ্নটা ততবারই মাথায় আসত যতবার খাঁচাটার দিকে চোখ পড়ত। খাঁচাটা ছোট বলেই হয়ত প্রাণিটা স্থির থাকতে পারত না। বিশাল জন্তুটাকে আজ শান্ত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখার সৌভগ্য হল শেষপর্যন্ত। শুয়ে থাকার পরেও জায়গা হচ্ছিল না বেচারার, পেছনের পা দুটো বাঁশের গরাদের ফাঁক গলে হাটু অবধি বাইরে বেরিয়ে আছে। দেখে বেচারার জন্য দুঃখও লাগল। হাসিও আসল।

হঠাৎ কানে আসল কে যেন গান গাইছে৷ ছোটবেলায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিশেষ অনুষ্ঠানে এধরনের সুর শুনতাম। মনটা আরও আনন্দে নেচে উঠল। আজ যেন আমার আনন্দের ষোলো কলা পূর্ণ হবেই।

নির্জন পাহাড়ি রাতের ভয় তখন আমার মধ্যে বিন্দু মাত্র নেই। এই অসাধারণ সুন্দর পবিত্রতার মাঝে ভয় শঙ্কা কাজ করার কথাও নয়। শুনে যতদূর মনে হল সামবেই ঝোঁপঝাড়ের মাঝে একটা ছোট্ট ফাঁকা চত্বরের আছে৷ সেখান থেকে আসছে গানের সুর। দিনের বেলা দেখেছিলাম চত্বরটা। শুনে যতটা বোঝা গেল বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষের জটলা ওখানে। একসাথে গান গাইছে সবাই।

মাঘি পূর্ণিমার উৎসবের রাত। কয়েকজন হয়ত এখনও গান বাজনা করছে। তখন মূল অনুষ্ঠানে পাহাড়িদের নিজস্ব সংস্কৃতির কিছু করতে দেখা যায়নি। এখন বোধহয় একটা ছোট দল নিজেদের মত করে এখানে আবার আসর সাজিয়ে বসেছে। আমার একবারের জন্যও মনে পড়ল না যে মাঘি পূর্ণিমা বৌদ্ধদের উৎসব। আর আমি আছি বম পাড়ায়। এই বমরা ধর্মে খ্রিস্টান। বৌদ্ধ পূর্ণিমার উৎসব এখানে হওয়ার কথা নয়।

তখন মারমা পাড়ায় উৎসবে পাহাড়ি সংস্কৃতির কিছু না দেখার আফসোস থেকেই বোধহয় আমি একবার গিয়ে দেখে আসাই ঠিক করলাম। একা যাব? যাই না হয়, সবাই ঘুমাচ্ছে ডেকে কাজ নেই। আর আজ রাতের এত সৌন্দর্যে উপভোগের সময় কেউ ছিল না। এখন না থাকলেই কি। কাল এসব কাউকে বল্লেও বিশ্বাস করবে না। মুখ বেঁকিয়ে বলবে বাড়িয়ে বলছি। তাই কাউকে ডেকে দেখিয়ে সময় নষ্ট করার চিন্তা বাদ দিয়ে নামতে শুরু করলাম সিঁড়ি বেয়ে।

বেশ অনেকগুলোই সিঁড়ি। নামতেই গান আরও ভালভাবে কানে আসতে লাগল। উপর থেকে যতটা সুন্দর লাগছিল, নিচে এসে গান যখন আরও ভালোভাবে কানে আসল তখন বুঝলাম, যতটা ভেবেছিলা গানের সুর তার চেয়েও সুন্দর। আমি গান ভালোবাসি। স্কুল জীবন থেকে গিটারের সাথে সখ্যতা। গানের ভালো খারাপ আমার কানে একটু হলেও ধরা পরে৷ গানের সেই যৎসামান্য ধারণা থেকেই বুঝতে পারলাম এই সুর বেশ প্রাচীন। এসব শুনতে সবসময়ই সবারই ভালো লাগে৷

সিঁড়ি বেয়ে যেখানে নেমেছি সেই জায়গাটা একটু সমতলের মত, ঢালু নয়। গাছের ছায়ায় দৃষ্টিসীমা কমে গেছে। ওদিকটাতে তেমন দেখা যায় না। তবে মোটা শূকরের খাঁচা পেরিয়ে একটু গেলেই দেখতে পাব গায়ক-গায়িকাদের।

কয়েক পা এগোতেই ঝোপে সামান্য পায়ে চলার শব্দ। ততক্ষণে আমি খাঁচাটা পেরিয়ে গেছি প্রায়। তবে পায়ের শব্দ আমার নয়। খাঁচার ওদিকটা থেকে আসছে। সাপখোপ নয় তো! তাকাতেই দেখি একটা মেয়ে। মাথায় পাহাড়ি মেয়েরা যেমন টুপির মত পরে তেমন টুপি। চাঁদের আলো আধারিতে মস্তকারণটাকে মুকুটের মত লাগছিল। তরুনী শরীরের সুন্দর অবয়বও স্পষ্ট। কিন্তু চেহারা দেখা যায় না। মেয়েটা পাহাড়ি টান মেশানো বাংলায় একটু টেনে টেনে বলে উঠল, “ওকানে যেওনি, বাবু। ওকানে যেওনি!”

আমি থমকে দাড়ালাম, ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মেয়েটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। তার টেনে টেনে বলা কথায় আদেশের কোনো ইঙ্গিত ছিল না কিন্তু ওই কথা উপেক্ষা করা কারো পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয় না। আমাকে দাঁড়াতে দেখে, সে আবার বলে উঠল, “ওকানে যেওনি, বাবু।” এবার গলা স্থির।

দ্বিতীয়বার বলার পরেই এক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে আমি বুঝে ফেললাম, এখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ানো উচিত হবে না। পেছনে ঘুরে প্রানপনে হেঁটে চলে আসলাম ঘরে। চাঁদ তখনও পৃথিবী ভাসিয়ে চলেছে। দূরে প্রাচীন পাহাড়ি সুরের গান তখনও গেয়ে চলেছে।

পরদিন সকালে বাইরে বেশ হইচই। হইচই বলতে উচ্চস্বরে কথাবার্তা আর কি। আমার সঙ্গীরা আমার আগেই উঠে পড়েছে। কেউ ঘরে নেই। আমিও বাইরে আসলাম। বারান্দা থেকে নামতেই, সফরসঙ্গী বড় ভাই বলল, “কাল রাতে খাঁচায় রাখা ওই বড় শূকরটা মারা গেছে। সেটাই ফেলে দিতে যাচ্ছে ওরা।”

এগিয়ে দেখলাম ব্যাপারটা তাই। শূকরটাকে একটা মোটা বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে উঠিয়ে নিল চারটা জোয়ান লোক। দেখার জন্য কৌতুহলি কয়েকজনের সাথে আমিও দাঁড়ালাম আগের রাতের সেই মাটি কেটে বানানো সিঁড়ির  উপর।

আমি একটু দলিয়ান দাদা আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। সুযোগ বুঝে আমি আস্তে ধীরে জিজ্ঞেস করলাম, “দাদা, কাল রাতে দেখলাম ওই খাঁচার কাছে একটা মেয়ে।”

“তুমি কীভাবে দেকলে?” প্রচন্ড চমকে পালটা প্রশ্ন করলেন দলিয়ান দা।

“কাল রাতে ঘুম আসছিল না, একটু বাইরে এসেছিলাম।” দাদার প্রতিক্রিয়া দেখে খুব অবাক হয়ে উত্তর দিলাম।

“তোমাকে না বলেচি রাতের বেলা বের না হতে!”

“কিন্তু দাদা ওইখানে তো কয়েকজন গান গাইছিল রাতে।”

“হায় হায় হায়! কি অনত্থ করেচ দাদা! এ কি করেছ! তোমাদের হাজারবার বলেচি সন্ধ্যা পর বাইরে থাকবে না। খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েচ গো! খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েচ।” এটুকু বলেই চুপ হয়ে গেল দাদা। চেহারায় রাগ, হতাশা, স্বস্তি সব একসাথে। একটা মাত্র সপ্তাহের দেখায় লোকটা ভালোবেসে ফেলেছে আমাকে।

তখনই আমার মনে পড়ল যে কদিন দলিয়ানপাড়াতে ছিলাম কোনোদিন সন্ধ্যা একটু ঘনিয়ে আসার পর পাড়ার কাউকে আর ঘরের বাইরে বসতে, গল্পগুজব করতে বা রাত্রিকালীন আড্ডা দিতে দেখিনি। সন্ধ্যা পেরুলে এসব বৈঠক হয় ঘরের ভেতর।

এরপরের কথাগুলো দলিয়ান দাদার পেট থেকে বের করতে একটু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অবশ্য। তবে খুব না। আমি জানি কীভাবে মানুষের সাথে কথা বলতে হয়।

আগের রাতে আমি যাদের গলায় পাহাড়ি গান শুনেছি তাদের স্থানীয়রা বলে ‘ডামাবাণু’। এরা হল এক ধরনের পাহাড়ি অশরীরী স্বত্বা বা জীন-পরী গোছের কিছু। এসব পাহাড় আগে তাদেরই বসতি ছিল। পাহাড়ি মানুষ এসে ঘর বাধার পর থেকে মানুষের উপর আক্রোশ ওদের। আপন ভূমিতে অনধিকার চর্চা কেই বা ভালো চোখে দেখে। মাঝে মাঝে চাঁদের আলোতে বেরিয়ে আসে ওরা। গান গায়, নাচে, ফুর্তি করে৷ কিন্তু মানুষ দেখলেই জব্দ করে। বেশিরভাগ সময়ই মেরে ফেলে। কেউ বেঁচে গেলেও বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়। তাই ওদের তুষ্ট রাখতে গ্রামের ঢোকার মুখেই একটা জন্তু রাখা হয়, পরিতোষক হিসেবে। যাতে ওরা গ্রামে ঢোকার আগেই জন্তুটা চোখে পড়ে এবং আক্রোশটা ওটার উপরই ঝেড়ে চলে যেতে পারে। এরকম মাসে অন্তত একটা প্রাণি ডামাবানুদের উৎসর্গ করতে হয়ে। কোনো মাসে দুতিনটা শুকর বা ছাগল মারা পরে ওদের হাতে। মারা পড়া জন্তুকে জঙ্গলের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে আসতে হয়। ডামাবাণুরা সেই মৃত প্রাণি আহার করে। জন্তু ওই নির্দিষ্ট জায়গায় না ফেললে অল্পসময়ের মধ্যেই আবার আক্রান্ত হতে হয়। আবার পাড়ার সামনে খাঁচায় না জীবন্ত কিছু না পেলেই আঘাত আসে পাড়ার ভেতর। সেক্ষেত্রে সাধারণত শিশু বা মানুষ হয় প্রধান শিকার। কারণ নারী আর শিশুরাই ভবিষ্যত নিশ্চিত করে। নারী আর শিশু কমলে বিদেশিরা সংখ্যায় কমবে, কমতে কমতে একদিন হয়ত ডামাবাণুদের তল্লাট ছেড়ে চলে যাবে। এরকম একটা বিশ্বাস নাকি কাজ করে।

এতদিনে পাড়ার মুখেই ছোট্ট খাঁচায় বিরাট শূকর ঠেসে রাখার মত অপ্রীতিকর কাজটার পেছনের কারণটা বুঝলাম। এ যেন পরভূমিতে বসবাসের খাজনা দেয়া।

আর গতরাতে আমি যখন শূকরটাকে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম, তখনই সম্ভবত জন্তুটা মৃত ছিল। আর যে মেয়েটা আমাকে ওদিকে যেতে নিষেধ করছিল, তিনি হলেন দেবী বৈবিভা। পরে জেনেছি, দেবী বৈবিভা হলেন চন্দ্রকুমারী দেবী। চাঁদের আলোয় সকল অশুভ থেকে বন পাহাড়কে আগলে রাখেন এই চিরকুমারী চন্দ্রের দেবী।

এই ছিল পাহাড়ের দেবীর সাক্ষাৎ পাওয়ার অভিজ্ঞতা। আমার যুক্তিবাদী মন দলিয়ান দাদার বয়ানকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক পাহাড়ি কারাবারির ভ্রান্ত ধারণা ভেবে উড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে কানে স্পষ্ট বাজতে থাকে,, “ওকানে যেওনি, বাবু, ওকানে যেওনি!”

এ গলার স্বর ভোলার নয়!

সমাপ্ত


বিদ্র: কিছু টাইপো আর ছোট খাটো এডিটের কাজ রয়ে গেল। আপাতত আর সেগুলোতে হাত দিতে ইচ্ছে করছে না। পরে ঠিক করে নেব। জনপ্রিয় লেখক ও পরিচালক সিদ্দিক আহমেদ-এর প্রকাশিতব্য ঐতিহাসিক রোমাঞ্চপন্যাস ‘স্বর্ণবাজ’-এর জন্য আয়োজিত গিভএওয়ে উপলক্ষ্যে সাইটে আপলোড দেয়া হল। পরবর্তীতে সরিয়ে ফেলা হতে পারে। এই গিভএওয়ে হল একটা পার্সোনাল ট্রিবিউট, একজন লেখক ও পরিচালকের জন্য, যার উপর আমার আস্থা আছে।

– মহিউল ইসলাম মিঠু

Author: Moheul I Mithu

মহিউল ইসলাম মিঠু কৌতুহলী মানুষ। জানতে ভালোবাসেন। এজন্যই সম্ভবত খুব অল্প বয়সেই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। পড়ার অভ্যাসটাই হয়তো ধীরে ধীরে লেখার দিকে ধাবিত করেছিল। তার পাঠকপ্রিয় অনুবাদ গুলোর মধ্যে রয়েছে: দি হবিট, দি লর্ড অফ দ্য রিংস, পার্সি জ্যাকসন, হার্ড চয়েসেজ, দি আইস ড্রাগন, লিজিয়ন, প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে, দি আইভরি চাইল্ড ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রথমসারির জাতীয় পত্রিকা, সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইটের জন্য লিখেছেন বিভিন্ন সময়। তিনি বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন কিশোর-ম্যাগাজিন ‘আজবদেশ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। বিশ্বখ্যাত ২০টির বেশি বই অনুবাদ করে বিভিন্ন স্তরের পাঠকের আস্থা অর্জন করেছেন, জিতে নিয়েছেন ভালোবাসা। তার অনুদিত কিছু বই বিভিন্ন সময় জাতীয় বেস্ট-সেলারের তালিকাগুলোতে ছিল। (লিখেছেন: লে: কর্নেল রাশেদুজ্জামান)

Share This Post On

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link
Powered by Social Snap