বিচার বহির্ভূত হত্যা কি বন্ধ হবে না?

প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটা নিউজ লিখতে বসতে বাধ্য করল। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবারে প্রকাশিত খবরটা আমি পড়লাম ।

নিউজে বলা হচ্ছে, ময়মনসিংহে যৌথ বাহিনির অভিযানে আটক একজন বিএনপি নেতা নিহত হয়েছেন। সাইদুল ইসলাম নামে ওই নেতার বয়স ৪০ বছর বলে বলা হয়েছে খবরে।

সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪) রাত ১০টায় যৌথ বাহিনির অভিযানে আটক করা হয় সাইদুল ইসলামকে। পরে রাত ১টায় তাকে মৃত অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনির সদস্যরা। তার সাথে আরও কয়েকজনকে হাসপাতালে নিয়ে আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনি, তারপর প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়।

নিহত সাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবি, জমি ও বালুমহাল দখল, অস্ত্র প্রদর্শন সহ অনেক অভিযোগ আছে। অপরাধ করলে সেটার বিচার করতে হবে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনির হেফাজতে অপরাধীর মৃত্যু মেনে নেয়া যাবে না। 

নিহতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে কিন্তু ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে কোনো কথা বলেনি সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ। এমনকি যেই ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে ময়নাতদন্ত হয়েছে তিনিও কিছু বলতে চান নি। 

extrajudicial killing in Bangladesh continues

এছাড়া ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বিবিসিতে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, গোপালগঞ্জ ও গাইবান্ধায় যৌথবাহিনির অভিযানে গ্রেফতারের পর যথাক্রমে দুইজন ও একজন আসামির মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকজন আসামি বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশ যদিও বলছে, মৃত সবাই আগে থেকেই অসুস্থ ছিল। কিন্তু মৃতদের পরিবার বলছে ভিন্ন কথা। গাইবান্ধায় নিহত আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাব হোসেনের আপেল ও শফিকুল ইসলামের পরিবার বলছে, মারধর ও নির্যাতনের কথা। এবং পরিবারের দাবি অতিরিক্ত মারধরের কারণেই আসামিদের মৃত্যু ও অসুস্থতা ঘটেছে। তাদের মৃত্যুর পর এলাকাবাসী মানববন্ধনও করেছে। ময়নাতদন্তের পর তাদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হলেও, ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ নিয়ে কোনো তথ্য নেই প্রকাশিত খবরে।

প্রধান উপদেষ্টা ইউনুস মন খুলে সমালোচনা করতে বলেছেন। তাই বলছি, বিগত সরকারের প্রতি সারা দুনিয়ার এত বিরক্তির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। ইউনুসকে আমি পছন্দ করি, তার সরকারের কপালে একই কালিমা দেখতে চাইনা। আগে আমরা ক্রসফায়ারে মৃত্যুর খবর অনেক শুনেছি, কিন্তু হেফাজতে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার খবর কমই ছিল। কিন্তু নতুন বিপ্লবি সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর মারধর নির্যাতন করে মেরে ফেলার অধিকতর মধ্যযুগীয় আচরণের অভিযোগ পাচ্ছি আমরা। পত্রপত্রিকায় যে খবর আসছে, ঘটনার পরিমান নিসন্দেহে তার চেয়ে অনেক বেশি।

সাইদুল ইসলাম, সোহরাব হোসেন আপেল আর শফিকুল ইসলাম, যেভাবেই মারা যাক, সঠিক তথ্য মানুষকে জানাতে হবে। কেউ অপরাধি হলে বিচার করতে হবে। বিএনপি, জামাত, আওয়ামী লীগ, যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন বিচার ছাড়া হত্যা মানে খুন। প্রতিটা খুনের বিচার হতে হবে, এবং যতদিন পর্যন্ত একটাও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটবে ততদিন পর্যন্ত আমরা কেউ নিরাপদ নই। 

আমরা যেমন চাইনা কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন চাদাবাজি দখলবাজি বিশৃঙ্খলা করুক, তেমনই চাইনা সেসব থামাতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনির হেফাজতে মানুষ মরুক। কেউ যদি আপরাধী হয় তার বিচার করতে হবে, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার অপরাধীরও আছে।  অপরাধকে অপরাধ দিয়ে দমন করতে হলে যে অবস্থার  তৈরি হয় সেটাকে বলে অ্যানার্কি। যে স্বপ্নের বাংলাদেশের জন্য জুলাই আন্দোলন হল সেই বাংলাদেশে এনার্কির জায়গা নেই। আমরা আইনের শাসনে সুন্দর থাকতে চাই। যারা আইন মানতে বাধ্য করবে এই আইনের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল মানুষের দেশে তারাই যদি আইনের তোয়াক্কা না করে, তাহলে বাকিরা আইন মেনে চলবে, মব জাস্টিস করবে না, আইন হাতে তুলে নেবেনা, সেটা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

ভালোর শুরুটা সরকার এবং তার কর্মচারীদের কাছ থেকেই আসতে হবে। তারপর অন্যরা তার সাথে যুক্ত হতে থাকবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনির গ্রেফতারের পর এই সব মৃতু্্যর তীব্র প্রতিবাদ, সঠিক তদন্ত, তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ ও বিচারের দাবি জানাচ্ছি।

বিচার বহির্ভূত হত্যা নিয়ে বন্ধ না হলে সাধারণ মানুষের উপর রাষ্ট্রের অত্যাচার বন্ধ করা যাবে না। আমরা নিরাপদে থাকতে চাই, আইনের শাসন চাই, অত্যাচারের ভয়ে তটস্থ থাকতে চাই না। জুলাই মাসে সরকার-বিরোধী আন্দোলন সবচেয়ে বেগবান হয়েছিল যে কয়টা কারণে তার একটা ছিল, রাষ্ট্রযন্ত্র দেশের অনেকগুলো মানুষকে কোনো আইনীপ্রক্রিয়া, জবাবদিহিতা ছাড়াই শুধু ‘মন চেয়েছে এবং চাইলেই পারি তাই’ রাস্তায় মেরে ফেলেছে। তারা এভাবে গুলি করতে পেরেছিল তার কারণ অনেকদিন ধরে তারা দেখছিল, প্রয়োজন হলে যে কাউকে ধরে নিয়ে গুম করা যায়, ক্রসফায়ারের নাম দিয়ে মেরে ফেলা যায়। এখন বিপ্লবী সরকারের বিজয়ের পর এই বিচার বহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতি যদি আবার ফিরে আসে তাহলে, এই সরকার বা পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার আবার ঘাতক হয়ে ওঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

তথ্যসূত্র:

১। https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/q3jt97aej5২।https://www.bbc.com/bengali/articles/cql3l6ne2ylo

Author: Moheul I Mithu

মহিউল ইসলাম মিঠু কৌতুহলী মানুষ। জানতে ভালোবাসেন। এজন্যই সম্ভবত খুব অল্প বয়সেই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। পড়ার অভ্যাসটাই হয়তো ধীরে ধীরে লেখার দিকে ধাবিত করেছিল। তার পাঠকপ্রিয় অনুবাদ গুলোর মধ্যে রয়েছে: দি হবিট, দি লর্ড অফ দ্য রিংস, পার্সি জ্যাকসন, হার্ড চয়েসেজ, দি আইস ড্রাগন, লিজিয়ন, প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে, দি আইভরি চাইল্ড ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রথমসারির জাতীয় পত্রিকা, সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইটের জন্য লিখেছেন বিভিন্ন সময়। তিনি বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন কিশোর-ম্যাগাজিন ‘আজবদেশ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। বিশ্বখ্যাত ২০টির বেশি বই অনুবাদ করে বিভিন্ন স্তরের পাঠকের আস্থা অর্জন করেছেন, জিতে নিয়েছেন ভালোবাসা। তার অনুদিত কিছু বই বিভিন্ন সময় জাতীয় বেস্ট-সেলারের তালিকাগুলোতে ছিল। (লিখেছেন: লে: কর্নেল রাশেদুজ্জামান)

Share This Post On

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link
Powered by Social Snap