একটানা পড়ে শেষ করলাম শামস রহমানের লেখা “বঙ্গবন্ধু: নেতা, নেতৃত্ব ও আজকের বাংলাদেশ”। পড়ার পরে এবং পড়ার সময় একটা রিভিউয়ের খসড়া লিখতে শুরু করেছি। সেটাই এখানে তুলে দিচ্ছি, কারণ পরে পোস্ট করব ভেবে রেখে দিলে আর পোস্ট করা হবে না কোনোদিন। আপাতত এটাই পোস্ট করে দিচ্ছি।
যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান সম্পর্কে জানতে চান, এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ যে সংকটের মধ্যে দিয়ে গেছে সেগুলো সম্পর্কে খুব ভ্যালিড তথ্য চান, তাদের জন্য এই বইটা একটা অসাধারণ চয়েজ হতে পারে।
সাথে প্রতিটি তথ্যের যথাযত রেফারেন্স এবং বইয়ের শেষে একটা ইনডেক্স বইটিকে রেফারেন্স বুক হিসেবেও উপযোগী করে তুলেছে।বইটা পড়ে আমার সত্যিই ভালো লেগেছে কারণ, বইটা আমার ভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে, নতুন তথ্য দিয়েছে, আগের ধারণাকে আরও শক্তিশালী করেছে, আর নতুন চিন্তার খোড়াক দিয়েছে।
বই: বঙ্গবন্ধু- নেতা, নেতৃত্ব ও আজকের বাংলাদেশ
লেখক: শামস রহমান
প্রকাশক: বইপত্র
প্রকাশকাল: ২০২১
পৃষ্ঠা: ১৭৬
মূল্য: ৩৫০টাকা
লেখক পরিচিতি:
বইটি লিখেছেন শামস রহমান। ভদ্রলোক পেশায় একজন শিক্ষক। অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
তার লেখার সাথে এটাই আমার প্রথম পরিচয়। তার সম্পর্কে যতটুকু জানলাম তার পুরোটাই লেখক পরিচিতি থেকে। এর আগে দুটো কাব্যগ্রন্থ তিনি লিখেছেন।
এই বই পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, লেখকের প্রবন্ধ লেখার হাত খুবই শানিত, স্পষ্ট এবং অল্প কথায় সুন্দরভাবে মূলবক্তব্য উপস্থাপন করতে অভ্যস্ত। যার প্রতিটিই আমার পছন্দ।
লেখক দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ও প্রবাসী পত্রপত্রিকায় কলাম লিখছেন।
বই সম্পর্কে:
বইটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কিছু প্রবন্ধের সংকলন। প্রতিটি অধ্যায় একেকটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধগুলোতে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বের সাথে বর্তমান সময়ের একটি মেলবন্ধন এবং তার নেতৃত্ব কীভাবে এখনও খুবই প্রাসঙ্গিক সেটা দেখানো হয়েছে সহজ ভাষায়। আর এসব আলোচনা পড়তে গিয়ে আমার মনে বারবার যে কথাটা বাজছিল সেটা হল, ভালো নেতৃত্ব চিরন্তন, ভালো নেতৃত্ব সবসময়ই প্রাসঙ্গিক।
তবে বইয়ের শেষের অধ্যায়গুলোতে কিছু অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, এগুলো সম্ভবত লেখকের পেশাগত অভিজ্ঞতারই বাই-প্রোডাক্ট (উপজাত)।
এই বই নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে, প্রতিটি প্রবন্ধ নিয়ে আলাদাভাবে বলাই সবচেয়ে সঙ্গত হবে সম্ভবত, তাই সেভাবেই চেষ্টা করছি।
১. বঙ্গবন্ধু নেতা ও নেতৃত্ব
এই প্রবন্ধে লেখক একজন ভালো নেতার বিভিন্ন গুণাবলির সাথে বঙ্গবন্ধুর তুলনা করেছেন, কীভাবে বঙ্গবন্ধু একজন অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠলেন এবং কেন তাকে সেরা নেতা বলা যায় তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন।
আলোচনায় লেখক ১৮৯৫০’র দিকে রাজনৈতিক দলের নাম ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে শুধু ‘আওয়ামী লীগ’ হওয়ার ব্যাপারে বলেছেন।
আওয়ামী মুসলিম লীগ নামটা থেকে মুসলিম শব্দটা বাদ দেয়া প্রসঙ্গে বাংলাপিডিয়ার রেফারেন্স দিয়ে লেখক বলেছেন, “মুসলিম শব্দটা বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন, এই অঞ্চলেরর রাজনীতিকে সার্বজনীন করেছেন।”
ব্যক্তিগতভাবে আমি এই বক্তব্যের সাথে একমত। উপরন্তু, এই আলোচনা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম নিয়ে যে বিভাজনটা শুরু হয়েছিল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তার ধারাবাহিকতা “আওয়ামী মুসলিম লীগ” থেকে মুসলিম শব্দটা বাদ দেয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ভূখন্ডে সেই বিভাজনটা শেষ হয়। একটু ভেঙে বলি। ১৯০৬ সালে উপমহাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস যাত্রা শুরু করার পর একটা সময় উপমহাদেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ নিজেদের উপেক্ষিত মনে করতে লাগল, যার ফলস্রুতিতে জন্ম হল “মুসলিম লীগ”। আবার পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর মুসলিম লীগ, অতঃপর আওয়ামী মুসলিম লীগ, যখন প্রভাবশালী হয়ে উঠল তখন পাকিস্তানের ভূখণ্ডে রয়ে যাওয়া হিন্দুরা ভাবতে লাগল, এই দলে তাদের অধিকারের প্রতিফলন ঘটছে না। দে মাইট হ্যাভ ফেল্ট লেফট এলোন। মুসলিম শব্দটা বাদ দিয়ে মুজিব এই ‘লেফট এলোন’ গ্রুপটাকে মূলধারায় আনলেন।
নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ও জনগণের প্রতি সততার প্রমাণ হিসেবে ৭ মার্চের ভাষণ, ছয় দফা আর মুজিনের স্বাধীনতার দীর্ঘ পরিকল্পনা সংক্ষিপ্তভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এটা করতে গিয়ে লেখক যে বক্তব্য দিয়েছেন আমি সেগুলোর সাথেও একমত।
শেখ মুজিবের নেতৃত্ব নিয়ে বলতে গিয়ে লেখক একসময় বাকশাল প্রসঙ্গও এনেছেন। কিন্তু আমি নিজে বাকশাল সম্পর্কে কম জানি তাই বাকশালকে সাপোর্ট করে যে ধরনের বক্তব্য লেখক দিয়েছেন সেব্যাপারে কোনো মন্তব্য করছি না।
বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে শেখ মুজিবের এত গুণগান দেখে মনে হচ্ছিল, দীর্ঘদিন থেকে দেশে আওয়ামী লীগের শাসন চলছে, তাই হয়ত লেখক একটু সেইফ সাইডে থাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেষে দেখলাম, এই প্রবন্ধ লেখক লিখেছিলেন ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায়। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। অর্থাৎ ওই সময়ে এই লেখা সাহস এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি লেখকের আস্থা এবং নিজের মতামতের প্রতি সৎ থাকার স্পষ্ট প্রমাণ।
এই সবকিছু মিলিয়ে বইয়ের প্রথম প্রবন্ধটাই আমাকে হুক কিরে ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিল।
২ . বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী; এক অপরিহার্য পাঠ
এই অধ্যায়ে লেখক বলার চেষ্টা করেছেন, বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী কেন আজকের তরুন সমাজের পড়া উচিত। এবং কেন তার আত্মজীবনীর শিক্ষা আজ প্রায় অর্ধশতাব্দী পরেও প্রাসঙ্গিক।
বইটির একজন পাঠক হিসেবে যে বিষয়গুলো লেখকের সামনে এসেছিল সেগুলো বেশ গুছিয়ে বর্ণনা করেছেন।
৩. বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক, জিয়া এনাউন্সার মাত্র
এই অধ্যায়ে লেখক বলেছেন, ঠিক কি কি কারণে জিয়াউর রহমান কোনোভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক হতে পারেন না।
স্বপক্ষে যুক্তি দেখতে গিয়ে তিনি বলেছেন, একজনের ঘোষণা আরেকজন প্রচার করলে, তাকে ঘোষক বলা যায় না। তিনি প্রচারকারী মাত্র।
আরেকটি যুক্তির অবতারণা লেখক করেছেন, এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। একটা দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য সে দেশের উপর, সেই দেশের মানুষের উপর যে কর্তৃত্ব বা অথোরিটির একজন নেতার থাকতে হয় সেটা তৎকালীন সময়ে প্রায় অপরিচিত জিয়াউর রহমানের ছিল না।
কেউ একজন যদি দাঁড়িয়ে “আমরা আজ থেকে স্বাধীন” বললেই যদি ওই জনগোষ্ঠী স্বাধীন হয়ে যেত তাহলে প্রতিদিনই একেকটা দেশ স্বাধীন হত। প্রতিটা গ্রাম-মহল্লায় চলত স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সবমিলিয়ে বেশ সফলতার সাথে এই প্রবন্ধে লেখক পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পেরেছেন যে জিয়াউর রহমানের পক্ষে কেন কোনোভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক হওয়া সম্ভব নয়।
৫. বঙ্গবন্ধু ও শেকড়ের কথা
লেখকের এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালে সেপ্টেম্বরে। কুখ্যাত ‘হোলি আর্টিজান’ হামলার কয়েকমাস পর।
এই হোলি আর্টিজানের সাথে লেখকের ব্যক্তিজীবনের সম্পর্ক থাকায় মাঝে মাঝেই হোলি আর্টিজানের আলোচিনায় লেখককে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতে দেখি। কিছুটা আবেগ-তাড়িত লেখাতেও লেখক একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার অবতারণা করেছেন, সেটা হল, রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে ধর্মের ব্যবহার আর জাতিকে একত্বকে ধ্বংস করতে কীভাবে যুগে যুগে শাসকরূপী শোসকশ্রেনী জাতির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছে।
একটা জাতির মধ্যে অদৃশ্য একটা বন্ধন থাকে, যে বন্ধনে সে জাতির মানুষ এক হয়ে থাকে, সেই বন্ধনটা হল সংস্কৃতির বন্ধন। বাইরের কোনো শক্তি যদি কোনো উপায় বা অযুহাতে এই বন্ধন ঢিলে করতে পারে, তাহলে সেই জাতির পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইতিহাসে এর প্রমাণ অনেক আছে।
মূলত এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এই অধ্যায়ে লেখক ‘বিয়িং ইনক্লুসিভ’ টার্মটা ব্যবহার করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, ধর্মেকে ব্যবহার করে “আজ বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় জঙ্গিবাদ মানুষের জীবন আর ধর্মীয় বিশ্বাস কেড়ে নিয়ে ‘বিয়িং ইনক্লুসিভ’ হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। মানুষকে বঞ্চিত করে আর যাই হোক, ইনক্লুসিভ পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।”
এছাড়া বঙ্গবন্ধু কীভাবে এই ‘বিয়িং ইনক্লুসিভ’ ধারণার চর্চা করতেন সেটা আলোচনা করা হয়েছে।
সবমিলিয়ে এই অধ্যায়ের মূল বক্তব্য হল, বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে মানুষকে একত্রিত করতে চেয়েছেন কিন্তু ১৯৭৫’র পর, ভিন্ন এক শক্তি ধর্মকে পুঁজি করে মানুষকে একত্রিত করতে গিয়ে মূলত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে যার ফলস্রুতিতে আমাদের সমাজে জঙ্গিবাদের মত জিনিসগুলো মাথাচারা দিয়ে উঠতে পারছে।
এ অধ্যায়ে কিছু লাইন রীতিমত কোট করার মতঃ
১। যে জাতি কৃষ্টিতে শূন্য, সে জাতি সৃষ্টিতে অপারগ আজন্ম।
২। যার ইতিহাস নেই, যে সংস্কৃতি শূন্য তাকে শোষণ করা সহজ।
এজন্যই পাকিস্তানের শুরুতেই পশ্চিমের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব-বাংলার মানুষকে নিজেদের ভাষা, বর্ণমালা, সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার পায়তারা করছিল।
৬. ছয় দফা
সাপ্তাহিক একতা নামক একটা পত্রিকার রেফারেন্স দিয়ে লেখক বইয়ের একাধিক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ভারতের আগরতলায় গিয়ে বঙ্গবন্ধু একাধিক ভারতীয় নেতাকে বলেছিলেন যে স্বাধীনতা ছাড়া বাংলার মুক্তি নাই। স্বাধীনতাই তার মূল লক্ষ্য।
অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের ১০-১১ বছর আগে থেকেই শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা ভাবছিলেন। এই ব্যাপারটিকে লেখক বইয়ের কয়েক জায়গায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দূরদর্শিতা আর দৃঢ়তার উদাহরন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আমি এই ঘটনার কথা আগে শুনিনি। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তারমানে এটাই দাড়াচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর বিরূদ্ধে যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার, তা একেবারে মিথ্যা নয়। (এই ব্যাপারটা নিয়ে আর কিছু বলছি না। তবে ব্যাপারটা আরেকটু খতিয়ে দেখায় ইচ্ছা রইল।)
এই প্রবন্ধে ছয় দফার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। যে আলোচনাটা বেশ ইন্টারেস্টিং সেটা হল, ছয় দফা প্রস্তাবের বিরোধীতা শুধু পশ্চিম পাকিস্তানিরাই করেনি, পূর্ব পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিবিদও এই ছয় দফাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে আলাদা করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছেন। তাদের মধ্যে একজন মওলানা ভাষানী এবং কারাগারের রোজনামোচা বইতে সেটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন শেখ মুজিব। ভাষানী ছাড়াও আরও অনেক বাঙালি নেতা যে ছয় দফার বিপক্ষে ছিলেন সেব্যাপারেও আলোচনা আছে এই অংশে।
এছাড়া এই ছয় দফার আইডিয়া কার মাথা থেকে বের হল সেব্যাপারেও কথা বলেছেন লেখক।
এই জায়গায় একটা কথা না বললেই নয়, লেখক ছয় দফা ছাড়াও আরও অনেক প্রসঙ্গে ভাষার ব্যবহার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। যেমনঃ ৭ মার্চের ভাষণের সময় বঙ্গবন্ধু জাতিকে “আপনারা” বলে সম্বোধন করতে শুরু করলেন, পরে “তোমরা” হিসেবে সম্বোধন করতে শুরু করলেন। ঠিক কোন মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে এই সম্বোধনগত পরিবর্তন সেব্যাপারেও ব্যাখ্যা লেখকের ইন্টারপ্রিটেশন পড়লে বেশ ভালো লাগে। এব্যাপারে লেখক শামস রহমানের বক্তব্য, ” আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে, সেই সাথে সাহস জুগিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের সাথেবেক বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হন। আর এএ মাঝে তিনি বাংলার জনগণকে ‘আপনারা’ থেকে ‘তোমরা’ বলে সম্মোধন করার অধিকার অর্জন করেন।” (পৃষ্ঠা১৫-১৬)
এই ভাষার ব্যবহারের সূত্র ধরেই লেখক ধারণা করছেন, ছয় দফা সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর ব্রেইনচাইল্ড। (পৃষ্ঠা ৬৭-৬৮) যেমনঃ ছয় দফা প্রস্তাব করার সময় লেখক কয়েকবার সরাসরি বলেছেন, “আমি প্রস্তাব করছি…..” প্রস্তাবনায় প্রথম পুরুষ বা ফার্স্ট পার্সনের ব্যবহার, এটাই ইঙ্গিত করে যে, ছয় দফা প্রস্তাব যতটা না দলীয় বা সমষ্টিগত চিন্তার ফসল, তার চেয়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত দূরদর্শিতার ফসল বেশি। লেখকের সেটাই মত।
আর আমি এখানে যোগ করতে চাই যে, ৬ দফা যদিওবা একজন ব্যক্তির দূরর্শিতার ফসল হয়, তাতেও এই প্রস্তাবের গুরুত্ব বা মাহাত্ম মোটেই কমে যায় না। বরং, পরে এই দাবির যৌক্তিকতা ও প্রাসঙ্গিকতা ছয় দফাকে গণমানুষের দাবিতে পরিণত করে।
প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশে লেখক বিভিন্ন প্রমাণাদি সহ ব্যাখ্যা করেছেন, ছয় দফা কেন একটি যৌক্তিক দাবি ছিল এবং এই দাবি কীভাবে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে পারত। লেখকের মতে, ছয় দফার বিরোধিতা যারা করেছেন তারা শক্তিশালী পাকিস্তান রাষ্ট্র চায়নি বরং শক্তিশালী কেন্দ্রিয় সরকার চেয়েছিল। (পৃষ্ঠা ৭০-৮২)
৭. বঙ্গবন্ধু ও বাকশাল
বইয়ের অর্ধেক পড়তেই লেখকে অন্তর্দৃষ্টি, ব্যাখ্যা আমার ভালো লাগছিল। তাই বাকশাল সম্পর্ক তার বক্তব্য জানার জন্য একটু বেশিই যেন উতলা হয়ে পড়েছিলাম। কারণ বাকশাল ব্যাপারটা আমাকে সবসময়ই বেশ দ্বিধান্বিত করেছে। আমি নিশ্চিত, আমার মত দ্বিধান্বিত তরুন আরও অনেক আছেন। প্রবন্ধের এবস্ট্রাক্টে লেখক বলেছেন, বাকশালের ব্যাপারে আমাদের মত তরুণদের যে অস্বচ্ছ ধারণা সেটা পরিষ্কার করাও এই প্রবন্ধের একটা উদ্দেশ্য।
এই অংশটুকু আমি লিখছি প্রবন্ধটা পড়ার আগে। এবার পড়ে দেখার পালা, লেখক সেই অস্বচ্ছ ধারণাকে কতটা স্বচ্ছ করতে পারেন। আই এম এক্সাইটেড। পড়া শেষে আমার বক্তব্য নিয়ে আবার ফিরব।
বাকশাল সম্পর্কে আমার সামান্য যা ধারণা (সেই সামান্য ধারণাও অবশ্য অনেক বিশেষজ্ঞের চেয়ে বেশি বলেই আমার মনে হয়) তাতে আমার মনে হয়েছে, স্বাধীনতা পরবর্তী সেই ভালনারেবল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিগুলোকে নিয়ে একটি সমম্বিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে চেয়েছিলেন যাতে সবাই মিলে দ্বন্দ্ব-দূরত্ব ভুলে একসাথে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
লেখক শামস রহমানও মূলত সে কথাই বললেন। ঠিক কোন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বাকশাল ব্যবস্থা শুরু করতে চেয়েছিলেন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে কেন এটাই তখন সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত ছিল সেটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। এই আলোচনা আমরা আগেও বিভিন্ন জায়গায় কম বেশি দেখেছি।
কিন্তু আমার আসলে প্রশ্ন ছিল, বাকশাল যদি তখনকার সময়ে সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তাহলে বঙ্গবন্ধু ঠিক কীভাবে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। এবং এব্যাপারে যদি কোনো প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়। কিন্তু বইতে সেরকম কিছু পাইনি।
তবে লেখক সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করেছেন, সেদিন যদি বাকশাল কার্যকর হল তাহলে কোন কোন সমস্যায় আজ বাংলাদেশকে জর্জরিত হতে হত না। যেমনঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়ে যেত, স্বাধীনতা বিরোধীরা ক্ষমতায় আসতে পারত না, রাজনীতির জন্য ধর্মের ব্যবহার দেখতে হত না, স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি হত না, সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসত।
এসবকিছুই হয়ত হত, আপাত দৃষ্টিতে হয়ত তাই মনে হয়, কিন্তু যা হয়নি সেটাকে ‘অবশ্যই হত’ ধরে নিয়ে একটা ব্যবস্থাকে সঠিক বলে সিদ্ধান্ত নেয়া খুব বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়না আমার।
তার চেয়ে বরং বাকশালের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা যদি আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারতাম, তাহলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ ও যুক্তিযুক্ত হত।
এবিষয়ে লেখক হয়তো আরও লিখবেন, আমার সেই লেখার জন্য অপেক্ষা থাকবে।
৮. জিয়াউর রহমান কি বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে জড়িত
এটা একটা বিরাট প্রশ্ন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ও মানুষের মনে বহুকাল ধরে চলে আসা এই প্রশ্নের উত্তরই খোঁজার চেষ্টা করেছেন লেখক-গবেষক শামস রহমান। এবং তথ্য-প্রমাণ রেফারেন্স সহ একটা সিদ্ধান্তেও পৌঁছেছেন।
এই প্রবন্ধ থেকে দুইটি কোট উল্লেখ করলে লেখকের সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।
প্রথম কথাটা আমেরিকান সাংবাদিক লরেন্স লিফশাল্টযের, “zia played perhaps the most crucial roles. He was the key ‘Shadow Man’.”
অন্য যে উক্তিটি উদ্ধৃত করতে চাই সেটা বইয়ের লেখক শামস রহমানের নিজের,”বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে জিয়া পূর্বেই অবহিত ছিলেন, চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নেননি, বরঞ্চ চক্রান্তকারীদের উৎসাহিত করেছেন এবং সেই সাথে আসন্ন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন।”
৯. আজকের বাংলাদেশ
বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে লেখক শামস রহমানের আলোচনা এখানেই শেষ। বইয়ের শেষ পাঁচটি প্রবন্ধ “আজকের বাংলাদেশ” নিয়ে। সেখানে তিনি কথা বলেছেন বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। প্রবন্ধ পাঁচটির নাম থেকেই আলোচ্য বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়।
প্রথমটি, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক দুর্বল বিরোধী দলই কাম্য
দ্বিতীয়টি, জাতীয় সংসদে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রতিনিধিত্ব
তৃতীয়টি, পৃথিবী আজ সমতল; উন্নয়নের সুযোগ নেওয়ার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়
চতুর্থটি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে শিক্ষা প্রদান
পঞ্চমটু, ‘ব্রেইন গেইন’ কৌশলঃ মানব সম্পদ আহরণের এক অফুরন্ত ভান্ডার
রিভিউ অনেক বড় হয়ে গেছে তাই এই প্রবন্ধগুলো নিয়ে বেশি বলব না। শুধু বলি সমকালীন এই চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে লেখকের তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা ভাবমার খোড়াক দেয়।
মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিষয়ে:
প্রিমিয়াম পেপারব্যাক বলে যেই ধরনের বই আমরা ইদানীং দেখতে পাচ্ছি। এটা সেরকমই। পৃষ্ঠা আর বাঁধাই খুব ভালো। সাইজে একটু ছোট পড়তে আর ক্যারি করতে খুবই আরাম। এইজন্য বইটা প্রায় পুরোটাই বাসে, ওয়েটিং রুমে আর অফিসে বসে পড়া হয়েছে। শুধু ফন্ট সাইজটা একটু ছোট হলেই আমার কাছে দেখতে আরেকটু ভালো লাগত কিন্তু বড় জন্যই বোধহয় পড়তে আরাম লাগছিল।
কিছু বানানভুল চোখে পড়েছে কিন্তু পড়তে কোনো সমস্যা হয় না।
শেষ কথা:
অল্পকথায় বললে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান সম্পর্কে জানতে চান, এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ যে সংকটের মধ্যে দিয়ে গেছে সেগুলো সম্পর্কে খুব ভ্যালিড তথ্য চান, তাদের জন্য এই বইটা একটা অসাধারণ চয়েজ হতে পারে।
তরুনরা এই বই থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন, আর যারা সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে আগে থেকেই পড়াশোনা করছেন তারা আগে থেকে জানা থাকা তথ্যের সম্মুখিন হবেন। তবে তাতে কোনো ক্ষতি নেই কারণ লেখকের ইন্টারপ্রিটেশন জানতে আসলেই ভালো লাগছিল।
লেখনী খুব আরামদায়ক।
সাথে প্রতিটি তথ্যের রেফারেন্স এবং ইনডেক্স বইটিকে একটা রেফারেন্স বুক হিসেবেও ক্রেডিবল করেছে। সবমিলিয়ে বইটা পড়ে আমি সত্যিই হ্যাপি, বইটা আমার ভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে, নতুন তথ্য দিয়েছে, আগের ধারণাকে আরও শক্তিশালী করেছে, আর চিন্তার খোড়াক দিয়েছে। আর দিয়েছে অনেকগুলো নতুন বইয়ের সন্ধান যা বাংলাদেশের রাজনীতির অতীতকে আরও ভালোভাবে জানত্ব সাহায্য করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
বইটা হাইলি রিকমেন্ডেড।