আমার প্রিয় জেনগল্প: নিজের মূল্য জানুন

zen story value of life
zen story value of life

একদিন এক তরুণ শিষ্য গেল তার জেনগুরুর কাছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “গুরু, আমার এই জীবনের মূল্য কত?”

জেন গুরু উত্তর দিলেন, “তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি দেব। কিন্তু তার আগে, পেছনের বাগানে যাও। দেখবে অনেকগুলো পাথর পড়ে আছে, সেখান থেকে একটা পাথর নিয়ে এসো।”

তরুণ শিষ্য একটা সুন্দর গোলগাল মসৃণ পাথর নিয়ে এলো। দেখে জেনগুরু বলল, “এবার যাও, এই পাথরটা নিয়ে বাজারের মোড়ে বসে থাকো। কেউ যদি দাম জিজ্ঞেস করে তাহলে কিছু বলবে না। শুধু দুটো আঙুল দেখাবে। তারপর তারা যত দামই বলুক তুমি শুনবে। কিছু বলবেও না, আবার পাথরটা বিক্রিও করবে না। ফিরে এসে আমাকে বলবে কত দাম বলেছে। এরপর উত্তর পাবে।”

পরের দিন সকাল সকাল শিস্য পাথরটা নিয়ে বাজারে গেল, এবং একটা সুবিধাজনক জায়গা বেছে বসে পড়ল। এক মহিলা এসে জিজ্ঞেস করল, “এই পাথরটার দাম কত?”

গুরুর কথামতো কোনো কিছু না বলে শুধু দুটো আঙুল দেখালো শিষ্য। মহিলা দেখে জিজ্ঞেস করল, “দুই টাকা?”

শিস্য কিছু না বলে, আবার দুই আঙুল দেখালো, এবার মহিলা জিজ্ঞেস করল, “বিশ টাকা?”

এবার শিস্য কিছু না বলে আবার দুটো আঙ্গুল দেখালো। দেখে মহিলা নিজেই বলল, “বিশ টাকার বেশি দিতে পারব না, বাপু। হলেও দিয়ে দাও। এটা দিয়ে খুব ভালো মসলা গুড়ো করা যাবে সত্যি, কিন্তু এটার জন্য বিশ টাকার বেশি এক পয়সাও খরচ করতে পারব না, খরচ করতে রাজিও নই।”

শিষ্য মনে মনে ভাবল। একটা পড়ে থাকা পাথরের জন্য একজন বিশ টাকা দিতে চাচ্ছে, এরকম পাথর তো শত শত আছে তাদের আশ্রমে। কিন্তু জেনগুরুর কথামত শিষ্য পাথরটা না বেচে ফিরে এলো।

এসে জেনগুরুকে বলল, “গুরুজী, এক মহিলা এই পাথরটা কেনার জন্য আমাকে বিশ টাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি বিক্রি করিনি, আপনার কথা মত বিক্রি না করে ফিরে এসেছি। এবার বলুন, আমার জীবনের মূল্য কত!”

জেনগুরু উত্তর দিল, “ঠিকাছে। খুব ভালো। আগামীকাল এই পাথরটাই আবার একটা জাদুঘরে নিয়ে যাবে। সেখানে যদি কেউ দাম জিজ্ঞেস করে, আবার কিছু বলবে না, শুধু আগের মতো দুটো আঙুল দেখোবে। যদি আবার কেউ দাম বলে, এবারও শুধু শুনবে, কিন্তু পাথরটা বিক্রি করবে না। দাম শুনে ফেরত আসবে। এসে আমাকে বলবে। তারপর তোমার উত্তর পাবে, বলব, তোমার জীবনের মূল্য কত।”

পরেরদিন শিষ্য যখন পাথরটা নিয়ে জাদুঘরে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাথরটাকে ঘিরে রীতিমত একটা জটলা তৈরি হয়ে গেল। জটলার মধ্যে থেকে একজন শিষ্যের দুই আঙ্গুল দেখে শুনে বলল,  “এই পাথরটার জন্য দুই হাজার দেব। এটা থেকে সুন্দর একটা মূর্তি খোদাই করা যাবে।”

একটা ফেলনা পাথরের জন্য এতগুলো টাকা। শিষ্যের ইচ্ছা করল, পাথরটা বেচেই দেয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করল কারণ জেনগুরু বলেছেন, শুধু দাম জানতে, বিক্রি করতে না। জেনগুরুকে দাম বললে, তিনি শিষ্যর জীবনের মূ্ল্য বলবেন। ওই শিষ্যর কাছে দুই হাজার টাকার চেয়ে নিজের জীবনের মূল্য জানাটা বেশি জরুরি ছিল।

সে আশ্রমে ফিরে গিয়ে জেনগুরুকে বলল, “গুরুজী, আজকে একজন এই পাথরের জন্য দুই হাজার দিতে চেয়েছে। আমি বিক্রি করিনি। এবার তো বলুন, আমার জীবনের মূল্য কত।”

শুনে জেনগুরু হাসলেন, বললেন, “এখনও না।কাল তুমি পাথরটা একটা অ্যান্টিক শপে নিয়ে যাবে,  যেখানে লোকে অনেক দাম দিয়ে পুরোনো জিনিসপত্র কিনতে আসে। তারপর কেউ যদি দাম জানতে চায়, তাহলে আগের মতই দুই আঙুল দেখাবে। তারপর কেউ দাম বললে, শুনবে, কিন্তু বিক্রি করবে না, জেনে ফিরে এসে আমাকে জানাবে।তারপর তোমার জীবনের মূল্য বলব।”

পরের দিনে অ্যান্টিক শপে অনেকে পাথরটা দেখল। এরমধ্যে একজন প্রথমেই শিষ্যের দুই আঙ্গুল দাম বলল, বিশ হাজার। তারপর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে করতে, আগ্রহী লোকজন, পাথরটার দাম দুই লাখ পর্যন্ত তুলে ফেলল। 

শিস্য ভেবে পেল না, এই এক পাথর যেটা আশ্রমের পেছনের বাগানে কতদিন মূল্যহীন জিনিসের মত পড়ে ছিল তার কোনো হিসাব নেই। আজ এই জিনিসের দাম উঠেছে, দুই লক্ষ টাকা। শিষ্য কিছু না বলে দৌড়াতে দৌড়াতে গুরুজীর কাছে এলো। ঘটনা বলল, “গুরুজী গুরুজী, আজকে একজন এই পাথরের দাম দুই লক্ষ টাকা বলেছে। আমি তুবও বিক্রি করিনি। এবার দয়া করে বলুন, আমার জীবনের মূল্য কত।”

এবার জেনগুরু ধীরেসুস্থে বললেন, “বত্‌স, তোমার মূল্য এই পাথরটার মত। তুমি যদি নিজেকে একটা বাজারের মোড়ে রাখো, তোমার দাম হবে ২০ টাকা, যদি জাদুঘরে নিয়ে যাও তাহলে দাম হবে দুই হাজার টাকা, আর যদি নিজেকে অ্যান্টিক শপের মত জায়গায় নিয়ে যেতে পারো, তাহলে তোমার দাম দুই লক্ষ টাকা। বিভিন্ন অবস্থান একই জীবনের মূল্য বিভিন্নরকম। জীবনের সম্ভাবনা অসীম, আর আমাদের জীবন কেমন হবে সেটা নির্ধারণের ক্ষমতাও আমাদের হাতে্ই আছে। আমরা যেমন বেছে নেব, আমাদের জীবনও সেভাবেই নির্ধারিত হবে। মাঝে মাঝে আমরা এমন জায়গায় আটকা পড়ে যাই যেখানে আমাদের মূ্ল্যায়ন সঠিক হয় না, বা আমরাও নিজেকে সে্ই জায়গায় যেতে পারিনা যেখানে সবো‍র্চ্চ মূল্যটা পাওয়া যাবে।”

“জীবন সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। নিজের জীবনকে নিজের মত সাজানোর ক্ষমতা আমাদের প্রত্যেকেরই আছে। মাঝে মাঝে একটু থেমে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত, আমি যা করছি যেভাবে করছি, যাদের সাথে মিশছি, যেভাবে মিশছি, সেটা কি ঠিক আছে নাকি অন্য কোনোভাবে সবকিছু সাজালে বেশি ভালো হত। প্রকৃতি আমাদের প্রত্যেককেই কোনো না কোনো বিষয়ে মেধা দিয়েছেন। এটা একটা বিশেষ উপহার। আমাদের উচিত সেই বিশেষ উপহারটার যত্ন করা, সেই উপহারটা যাতে উত্‌কর্ষ লাভ করতে পারে সেজন্য কাজ করা।  সবশেষে সেই উপহারটা যেন পৃথিবীর কাজে লাগে সেটা নিশ্চিত করা।”

“তবে সবার আগে নিজেকে বিশ্বাস করতে শিখতে হবে।আমরা নিজেরাই যদি আত্মবিশ্বাস না পাই, তাহলে অন্য আরেকজন আমাদের উপর কেন বিশ্বাস রাখবে। তাই সুযোগ পেলেই চুপচাপ নিজেকে জিজ্ঞেস করো, এখন তোমার অবস্থান কী এবং নিজেকে কোনে অবস্থানে দেখতে চাও তুমি। একটা জিনিস সবসময় মনে রাখবে, প্রতিটা দিনই নতুন শুরু, জীবনে যা চাও সেটা শুরু করার জন্য দেরি বলে কিছু নেই। সিদ্ধান্ত সঠিক হলে, প্রতিটা সময়ই সঠিক সময় হয়ে যায়।”

সংগ্রহ ও অনুবাদ: মহিউল ইসলাম মিঠু
তারিখ: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪

অডিওভার্সনটি শুনতে পারবেন এখানে:

Author: Moheul I Mithu

মহিউল ইসলাম মিঠু কৌতুহলী মানুষ। জানতে ভালোবাসেন। এজন্যই সম্ভবত খুব অল্প বয়সেই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। পড়ার অভ্যাসটাই হয়তো ধীরে ধীরে লেখার দিকে ধাবিত করেছিল। তার পাঠকপ্রিয় অনুবাদ গুলোর মধ্যে রয়েছে: দি হবিট, দি লর্ড অফ দ্য রিংস, পার্সি জ্যাকসন, হার্ড চয়েসেজ, দি আইস ড্রাগন, লিজিয়ন, প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে, দি আইভরি চাইল্ড ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রথমসারির জাতীয় পত্রিকা, সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইটের জন্য লিখেছেন বিভিন্ন সময়। তিনি বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন কিশোর-ম্যাগাজিন ‘আজবদেশ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। বিশ্বখ্যাত ২০টির বেশি বই অনুবাদ করে বিভিন্ন স্তরের পাঠকের আস্থা অর্জন করেছেন, জিতে নিয়েছেন ভালোবাসা। তার অনুদিত কিছু বই বিভিন্ন সময় জাতীয় বেস্ট-সেলারের তালিকাগুলোতে ছিল। (লিখেছেন: লে: কর্নেল রাশেদুজ্জামান)

Share This Post On

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link
Powered by Social Snap