গানের ভাবনা: ক্রুসেড – মেঘদল

গানের ভাবনা: ক্রুসেড- মেঘদল

গান: ক্রুসেড
ব্যান্ড: মেঘদল
অ্যালবাম: মেঘদল (রিমাস্টার্ড)

প্রথমবার শোনার পর টানা ২৫-৩০ বার শুনলাম। সবচেয়ে ভালো লেগেছে যেটা সেটা অনেক ইন্সট্রুমেন্টের একটা আনন্দদায়ক কম্বো। কিন্তু গানের টিউনটা খুবই পরিচিত যেন এধরনের টিউন বহুবার শুনেছি। তবে সেটা গান শোনার আনন্দকে মোটেও কমায়নি। বরং অসাধারণ লিরিকের জন্য বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। আর সব ইন্সট্রুমেন্টের কাজই ভালো কিন্তু ব্লোয়িং ইন্সট্রুমেন্টগুলো আলাদাভাবে মন টেনে নেয়। বাঁশি, ক্ল্যারিনেট আর সেক্সোফোনে আছেন সৌরভ সরকার। এই মানুষটার আরও কাজ দেখা দরকার।

গানের শুরুটা মজার:

মানুষের ক’জন ভগবান?
ক’জনে ভাগ্য লেখেন,
ক’জন জীবন সামলান?

গানের এইটুকু অনেকবেশি গভীর লাগল আমার। আর কথাগুলোর অর্থ খুবই ফ্লুইড। জীবনবোধের দিকেও নেয়া যায়, আবার গানের পরবর্তী অংশগুলোর সাথে মিলিয়ে একটা তীব্র ধিক্কার হিসেবেও নেয়া যায়।

শুধু সাধারণ জীবনযাত্রার সাথে মেলালে, ব্যাপারটা এমন, আমাদের সবার ভাগ্যই তো নিজেদের হাতে। কিন্তু আমরা কজনে সেই ভাগ্যটাকে নিজের পছন্দমত লিখতে পেরেছি। সবাই যেন কোনোরকমে জীবনটাকে সামলে নেয়া নিয়েই ব্যস্ত। এটা তো গেল, গানের সাথে অপ্রাসঙ্গিক একটা বিশ্লেষণ।

কিন্তু গানের পরবর্তী অংশের সাথে মিলিয়ে অর্থ খুঁজতে গেলে বোঝা যায়, এই প্যারাটা আসলে একটা তীব্র ধিক্কার। ধিক্কার তাদের প্রতি যারা এই পৃথিবীতে ভগবান হয়ে বসে আছেন আর মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছেন। এই ভগবানে শাসনে, মানুষ জীবন সামলাতেই ব্যস্ত, জীবনকে উপভোগ করার ফুসরত পাচ্ছে না। জীবন ব্যর্থ হচ্ছে। এই বিলিয়ন বিলিয়ন ব্যর্থ জীবনের জন্য ধিক্কার ওই ভগবানদের। এখানে আসলে অল্পকথায় পুরো ওয়ার্ল্ড অর্ডার, পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের শাঁখের কড়াত আর সারাপৃথিবীর আইডিওলোজিক্যাল যে যুদ্ধ সেটাকে ভয়ংকরভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে।

আকাশে উড়ছে বোমারু ভগবান,
মানুষ ঝলসে যিনি গণতন্ত্র এনে দেন।
মাটিতে পুতে আছে ক্লাস্টার ফুল,
ছুয়ে দিলে জ্বলে ওঠে, সে তো শিশুদের ভুল।
দু’হাত হারিয়ে আজ ডানা কাটা পরী যে শিশু,
শুনতে কী পাও তার চিৎকার পশ্চিমা যীশু?

এটুকু বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। পুরো গানটায় ভয়ংকর একটা দুঃখবোধ প্রকাশ পেয়েছে। উপরের কথাগুলো সেই দুঃখের উদাহরণসহ ব্যাখ্যা। এটুকুর পর সুন্দর একটা ইন্সট্রুমেন্টাল আছে। এই ৪ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড পর্যন্ত এসে গানটা শেষ হয়ে গেলে কোনো ক্ষতি হত না। কিন্তু তারপরেই একটা প্রতিরোধ।

শেষের অংশ:

“পৃথিবী জুড়ে চলছে যখন প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ মিছিল,
পিশাচের হাতে, হাত মেলালেন ব্লেয়ার,
জ্যাক শিরাক,ভ্লাদিমির পুতিন।”
ওরা রক্তের হিস্যা বুঝে নিতে চায় বুঝি গ্যালন গ্যালন!

এই অংশটুকু দিয়ে যেন বোঝানো হল, হে ভগবানরা, তোমরা অনেক কষ্টে রেখেছ আমাদের। কিন্তু আমরা ছাই চাপা আগুন। তোমাদের শাসনের উত্তাপে ফুঁসছি। সব দেখছি, শুনছি, মুখ বুজে সহ্য করছি। কিন্তু কখন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠব নিজেও জানি। সর্বব্যাপী অন্যায়, অবিচার আর অত্যাচারের বিরূদ্ধে এ যেন এক হুমকি।

শেষে ব্যক্তিগত একটা মতামত যোগ করতে চাই। পুরো গানটা ৬মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের। ৪ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের পর থেকে যেন ভিন্ন একটা গান। দুটো গানকে যেন জোর করে একসাথে করা হয়েছে। কিন্তু একজন শিল্পী তার শিল্পকে কীভাবে সাজাবেন এটা তার স্বাধীনতা। শিল্পীর স্বাধীনতা থাকলেই শিল্প সুন্দর হয়, বৈচিত্র্যময় হয়।

ইউটিউব চ্যানেলে গানের ট্যাকনিক্যাল ডিটেইলস সব দেয়া আছে। আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন। আমি পোস্ট আর বড় করলাম না।

Author: Moheul I Mithu

মহিউল ইসলাম মিঠু কৌতুহলী মানুষ। জানতে ভালোবাসেন। এজন্যই সম্ভবত খুব অল্প বয়সেই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। পড়ার অভ্যাসটাই হয়তো ধীরে ধীরে লেখার দিকে ধাবিত করেছিল। তার পাঠকপ্রিয় অনুবাদ গুলোর মধ্যে রয়েছে: দি হবিট, দি লর্ড অফ দ্য রিংস, পার্সি জ্যাকসন, হার্ড চয়েসেজ, দি আইস ড্রাগন, লিজিয়ন, প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে, দি আইভরি চাইল্ড ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রথমসারির জাতীয় পত্রিকা, সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইটের জন্য লিখেছেন বিভিন্ন সময়। তিনি বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন কিশোর-ম্যাগাজিন ‘আজবদেশ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। বিশ্বখ্যাত ২০টির বেশি বই অনুবাদ করে বিভিন্ন স্তরের পাঠকের আস্থা অর্জন করেছেন, জিতে নিয়েছেন ভালোবাসা। তার অনুদিত কিছু বই বিভিন্ন সময় জাতীয় বেস্ট-সেলারের তালিকাগুলোতে ছিল। (লিখেছেন: লে: কর্নেল রাশেদুজ্জামান)

Share This Post On

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link
Powered by Social Snap