প্রতিক্রিয়াটি দিয়েছেন শামীম রেজা। তাকে ধন্যবাদ।
দি লর্ড অফ দ্য রিংস!
এই একটা নাম দেখলেই আমাদের মাথায় চলে আসে সেই বিখ্যাত “মুভি ট্রিলজি”র কথা। আর এটাই আসা স্বাভাবিক। কেননা আমরা অনেকেই এই বিখ্যাত ৩ টি মুভি দেখলেও তারচেয়ে বিখ্যাত সিরিজটি কয়জনেই বা পড়েছি। হয়তোবা কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে গোগ্রাসে গিলেছে অমৃত সুধা পান করার মতো, সিরিজটি ইংরেজিতে পড়ে। আবার আমার মতোই অনেকেই আছে যারা এই-সেই অনেক কারণেই হয়তো পড়তেই পারেনি। আর এবার যখন বাংলাতে রুপান্তর হয়েছে আবার সেটা মিঠু ভাইয়ের মতো সুদক্ষ অনুবাদকের হাতে, তাহলে না নিয়ে পারা যায় না।
রিডার্স ব্লকে এক মাসের মতো থাকার পরে হাতে পেয়েই পড়ে শেষ করলাম আজ। রিভিউ না, এটা আমার পড়ার পরে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ বলতে পারেন।
কাহিনি সংক্ষেপ:
বহু বহু কাল আগে এলফরা অনেকগুলো জাদুর আংটি তৈরি করেছিল, রিং অফ পাওয়ার। এই আংটিগুলো ব্যবহারকারীকে খুব ক্ষমতাধর করে তুলত। অন্যদিকে আঁধার সম্রাজ্যের অধিপতি ডার্কলর্ড সাউরন একটা আংটি তৈরি করল, দি ওয়ান রিং! উদ্দেশ্য সব পাওয়ার রিং-এর উপর নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। এই এক আংটি দিয়ে সবার উপর কর্তৃত্ব করতে শুরু করল সাউরন। কিন্তু মিডল-আর্থের বীর জাতিগুলো অধিনতা স্বীকার করতে চাইল না। শুরু হল এক মহাযুদ্ধ। অনেক কষ্টে কোনমতে সাউরনের কাছ থেকে এই ওয়ান-রিং কেড়ে নেয়া সম্ভব হল। মিডল-আর্থে
ডার্কলর্ডের দৌরাত্ম থামানো গেল। কিন্তু সাউরন হাল ছাড়ার পাত্র নয়। হাজার হাজার বছর ধরে সে তার আংটি খুঁজে চলল মিডল-আর্থের প্রতিটি কোণে।
হাজার হাজার বছর ধরে অনেক হাত ঘুরে আংটিটা এসে পড়ল ফ্রোডো ব্যাগিন্সের হাতে। ফ্রোডো সবুজ ছায়াঘেরা শায়ার রাজ্যের এক শান্তিপ্রিয়, ছাপোষা, আরামপ্রিয় হবিট। হঠাৎ সে আবিষ্কার করল, পৃথিবীকে ভয়ংকর এক বিপদ থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব চলে এসেছে তার ছোট্ট দূর্বল কাঁধে।
এই এক আংটির শাসনে সবাই,
এই আংটিতে সব অশুভ ধাঁধা;
এই আংটির টানে আসে সবাই,
অশুভের জালে পড়ে যায় বাধা।
পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ
যেহেতু বইটির ২য় খন্ড মানে “ফেলোশিপ অফ দ্য রিং” এর পরবর্তী খন্ড সামনেই বের হবে, সেহেতু বইটির গল্প, চরিত্র, চরিত্রায়ন, চরিত্রের গভীরতা, সম্পর্ক ইত্যাদি কিছু নিয়েই আলোচনা করার ইচ্ছে নেই। কেননা বইটি শেষ হলেই সব কিছু পরিষ্কার করে আলোচনা করাটাকেই ভালো হবে বলে মনে করছি। তাই আজ শুধু অনুবাদ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, বইটির গল্প ছাড়া প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে পর্যালোচনা করব।
অহ! বলে রাখি। আমার অত্যন্ত প্রিয় অনুবাদক সালমান ভাইয়ের অনুবাদে এই বইটি আসার কথা। সেটা জেনেই দিনের প্রহর গুনছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে এই বইটি অন্য কারো কাছ থেকে আসায় সহজাত প্রবৃত্তির থেকেই নেয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু মুবিন ভাইয়ের কাছে এটির সুনাম আর অনুবাদকের দেয়া চ্যাপ্টার ১ পড়েই নিতে বাধ্য হয়েছি। তো, শুরু করা যাক-
খারাপ দিকঃ
শুধু মূল গল্পটিতে শুরু থেকেই শেষ পর্যন্ত আনুমানিক ১২ টির মতো বানান ভুল রয়েছে। যেমন- গ্যান্ডালাফকে একজায়গায় গ্যান্ডলফ, মেরিকে ম্যারি, পাহারাকে পরপর দুই জায়গায় পাহাড়ায়, আছড়ে কে আছাড়েসহ এরকম ১২ টির মতো ভুল পেয়েছি। আর গল্প ছাড়া শেষের দুই চ্যাপ্টারে পর পর কয়েকটি বানান ভুল পেয়েছি। তাছাড়া সম্মোধনে এক জায়গায় ভুল ছিল। ফ্রোডো একবার গ্যান্ডালফকে আপনির জায়গায় তুমি বলে ফেলেছিল, এমন মাঝখান জায়গায় যে পুরো বাক্যটি বিদঘুটে হয়ে গেছে। আবার এক গানের লাইনে মানে এই পুরো গানটির শেষের লাইনে শব্দ পরিবর্তন হয়ে গেছে। গানটি টম বোম্বাডিল শিখিয়ে দিয়েছিল, যখন বিপদে পড়বে তখন যেন গেয়ে সাহায্য প্রার্থনা করতে পারে। তো, টম যখন নিজেই তাদের বলে তখন গানের শেষের লাইনটি ছিল এরকম- “এসো টম বোম্বাডিল! চারদিকে যে বিপদের ঘনঘটা”। আর বিপদে পড়ে ফ্রোডো গাইলো একই গানেই শেষ লাইন এরকম করে- ” এসো টম বোম্বাডিল! চারদিকে বাজে বিপদেও ঘন্টা।” কোনটা সঠিক জানা নেই, না ফির ফ্রোডোই বিপদে পড়ে নিজেই এরকম গাইছে তা অজানা। অহ! ১ম চ্যাপ্টারটি হালকা কঠিন ছিল অনুবাদ। পরের থেকে সবকিছু ঠিকঠাক।
ভালো দিকঃ
অনুবাদঃ
এটি নিয়ে কিছু বললেই মনে হয় কম হয়ে যায় ভাই। জাস্ট অসায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ধারণ! মনেই হয়নি অনুবাদ পড়ছি। মনে হচ্ছিল,বাংলায় লিখিত কোন গল্প পড়ছি। শুরু থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে কোন কাঠিন্য ভাব ফুটিয়ে না তুলেই যে ভালো মানের অনুবাদ উপস্থাপন করা যায় তার উদাহরণ দেয়া যায় বলতে পারেন। এরকম অমর একটি বই, এরকম অনুবাদেরই যোগ্য। ফ্যান্টাসি হওয়ায় নানারকম চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, স্থান-কাল আসায় সেগুলো ভালোভাবে অনুবাদ করা চাট্টিখানি কথা না। তাছাড়া এত এত স্থানের প্রকৃতিকে যেভাবে সহজভাবে অনুবাদ করে অনুভব করিয়েছেন তা বলাই বাহুল্য।
গানের ভাবানুবাদঃ
এটি নিয়ে মনে হয় কিছু বলতে হবেনা। আমি নিজেই পড়তে পড়তে “থ্রিলার পাঠকের আসর” গ্রুপে ছবি তুলে কথায় প্রশংসা ঝড়িয়ে পোস্ট করেছিলাম। হাহা। বাংলারই (ইংরেজিতে না জানি কি ছিল) কঠিন শব্দগুলো কী সুন্দর আর মহনীয় ভাবেই না রুপান্তর ঘটিয়েছেন। হ্যাটস অফ!! আমি তো একই রকম সুর করে পুরো বইয়ের গানগুলো পড়েছি আর মুগ্ধের সাথে মাঝে মাঝে ভারাক্রান্তও হয়েছি। গানে গানে তো গল্পই বলা চলে একেকটা। অতি সুন্দর!
বই সংক্রান্তঃ
বইয়ের বাইন্ডিং ভালোই শক্তপোক্ত ছিল বলতেই হয়। পৃষ্টাগুলোও ঝকঝকা-ফকফকা ছিল। আর প্রচ্ছদে যেহেতু লেখক সাহেবটাকেই প্রাধান্য দিয়েছে, সেহেতু কোন মন্তব্য করছিনা। তাছাড়া চরিত্র বা স্থান-কাল বুঝাতে ছবি ও ম্যাপ ব্যবহার হয়েছে তা ছিল প্রশংসনীয়। আর এই বইয়ের মূল গল্প বাদে যেটি সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তা হল গল্পের শুরুতে হবিটদের নিয়ে “হবিটদের বিষয়ে কিছু কথা” ও শেষে ” কী কেন কীভাবে ও কাহিনির চরিত্রসমূহ” নামক চ্যাপ্টারগুলো সংযোজন করায়। হবিটদের আদি-অন্ত ইতিহাসের কিছুই জানা ছিল না। না ছিল তাদের বাসস্থান, বংশ-গোত্র, বৈশিষ্ট ইত্যাদি সম্পর্কে নির্দিষ্ট ধারণা! এটি দেয়ার ফলে গল্পে তাদের সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পেরেছিলাম। আবার শেষে মিডল-আর্থের অনেক কিছুই নিয়ে যা প্রশ্ন ও না বুঝা জিনিস ছিল তা কী কেন কীভাবে চ্যাপ্টারটি দ্বারা হালকা হলেও ক্লিয়ার হয়েছে। আর পরিশেষে, চরিত্রগুলো বুঝা খুব সহজতর হয়ে যায় কাহিনির চরিত্রসমূহ নামক চ্যাপ্টারটি থাকায়। অনুবাদক সাহেব, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দিব তা অজানা।
বইটির ১৫৭ পৃষ্টায় যখন মেরিকে “মিস্টার মেরিকে” বলে স্যাম সম্মোধন করে তখনই বুঝেছি সে ছেলে। নতুবা এত পৃষ্টা ধরে তাকে “মেয়ে” মনে করে পড়ে আমার অবুঝ মন! আর ভাই, টম বোম্বাডিলের বউ গোল্ডবেরির প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি সিরিয়াসলি। লেখক এভাবে উনাকে উপস্থাপন না করলেই পারতেন
পরিশেষে, বইটি পড়ার জন্য বলব আমি। এত বিখ্যাত এক সিরিজের বই এবং যার সবকিছুই এত সুন্দর তা না পড়ে যাবেন কই…
ধন্যবাদ ঐশ্বর্য প্রকাশ – Oishworjo Prokash প্রকাশনী। আমাদের পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে। ২য় খন্ডের অপেক্ষায় আছি।
বইটি একনজরেঃ
নামঃ দি ফেলোশিপ অফ দ্য রিং (১)
অনুবাদকঃ মহিউল ইসলাম মিঠু
প্রচ্ছদঃ মহিউল ইসলাম মিঠু
পৃষ্টা সংখ্যাঃ ৩৩৬
মুদ্রিত মূল্যঃ ৪০০ টাকা
প্রকাশনীঃ ঐশ্বর্য প্রকাশ
বইটির ব্যাপারে সব বিস্তারিত পাওয়া যাবে এখানে: