১৯৭২ সালে গঠিত বিতর্কিত রক্ষী বাহিনী নিয়ে আজকাল বেশ আগ্রহ বোধ করছি। বিভিন্ন বইপত্র, অনলাইন এবং সাক্ষাৎকারে রক্ষীবাহিনীর স্বরূপ কেমন ছিল সেটা খোঁজার চেষ্টা করছি। এই বাহিনী নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। গতকাল ইউটিউবে মেজর জেনারেল ইব্রাহিমের একটা সাক্ষাৎকার পেলাম। রক্ষীবাহিনি নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ কিছু লিখতে চাচ্ছি, কিন্তু সময় পাচ্ছিা না। বিগত কয়েকদিনের পড়াশোনায় মনে হচ্ছে, মুহম্মদ ইব্রাহিমের এই বক্তব্যটা রক্ষীবাহিনির ব্যাপারে বেশ ভালো একটা প্রাথমিক ধারণা দেয়, এইজন্য এই সাক্ষাৎকারটি নিজের ভাষায় এখানে লিখে রাখছি। এছাড়া বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্য এবং বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেনের লেখায় এব্যাপারে বেশ ভালো একটা ধারণা পেলাম। পরে পূর্ণাঙ্গ লেখাটা লিখতে যাতে ভুলে না যাই সেজন্য এই লেখাটা রিমাইন্ডার হিসেবেও কাজ করবে। সাক্ষাত্কারের পুরো ভিডিওটার লিংক দেয়া থাকবে কেউ চাইলে দেখে আসতে পারেন।
সাক্ষাৎকারে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহিম বলছেন, ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার একটা মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য হবেন, সদ্য শেষ হওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাগণ, এবং ইপিআর অর্থাৎ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদস্য বৃন্দ। এই বাহিনী গঠিত হয় পিলখানায়। প্রধান নিযুক্ত হন এ এন এম নুরুজ্জামান। এই নুরুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয়ার্ধের তিন নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তার বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলায়। তিনি ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন এবং বহুল আলোচিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের একজন ছিলেন। ষড়যন্ত্র মামলার পরে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনি থেকে চাকুরিচ্যুত হন এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝিতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ যখন এস ফোর্সের দায়িত্ব নিলেন তখন নুরুজ্জামানকে তিন নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়।
ইব্রাহিম বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিয়ার সদস্যদের মিশ্রণে এই মিলিশিয়া বাহিনি গঠন করাটা খুব একটা ভালো হয়নি। নব্য গঠিত বাহিনীতে অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ন্যাশনাল মিলিশিয়া বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। বক্তব্যের মাঝে মেজর জেনারেল ইব্রাহিম এটাও বলেন যে ওই সময় নুরুজ্জামান পিলখানায় যখন দরবার করছিলেন তখন বিদ্রোহ হয়েছিল, এমনকি অসন্তুষ্ট সদস্যদের ইটের আঘাতে তিনি আহত হয়েছিলেন। আরও বেশ কিছু উত্স থেকে ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়া যায়।
তারপর ন্যাশনাল মিলিশিয়া বাহিনীকে বিলুপ্ত করা হলে প্রশ্ন উঠলো, এই যে এতগুলো মুক্তিযোদ্ধাকে একত্রিত করা হলো এদের নিয়ে এখন কী করা হবে। শেষে সিদ্ধান্ত হল, শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করা হবে, যেখানে শুধু মুক্তিযোদ্ধারা থাকবে, কোন ইপিআর সদস্য থাকবে না । এই নতুন বাহিনির কাজ হবে আগের পরিকল্পিত মিলিশিয়া বাহিনীর মতই, শুধু ইপিআর সদস্যরা বাদ যাবে। এই বাহিনীর নাম দেয়া হলো জাতীয় রক্ষী বাহিনী, সংক্ষেপে জেআরবি। এই বাহিনীর সদর দপ্তর করা হলো শেরেবাংলা নগরে এবং বাহিনীর পরিচালক নিযুক্ত হলেন এ এন এম নুরুজ্জামান।
কাদেরিয়া বাহিনীর প্রচুর সদস্যকে রক্ষী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মতো রক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ‘অফিসার’ বলা হত না, বলা হত ‘লিডার’। এবং জুনিয়ার কমিশন অফিসারদের বলা হতো ‘জুনিয়র লিডার’।
রক্ষী বাহিনীর পোশাকটা ছিল ছিল হুবহু ভারতীয় সেনাবাহিনীর পোশাকের মত। এই বাহিনীর প্রশিক্ষণের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল সাভারে এবং সেখানে প্রশিক্ষণ দিতেন ভারতের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাবৃন্দ।
সেই সময় রক্ষী বাহিনী গঠনের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইব্রাহিম বলেছেন, রকি বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে, সর্বহারা দমনে এবং সরকার বিরোধীদের দমন করার জন্য গঠন করা হয়েছিল।
সাক্ষাৎকারে মেজর ইব্রাহিম আরও বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে চাকুরিসূত্রে রক্ষী বাহিনীর সাথে কাজ করেছেন। এই বাহিনীকে নিয়ে তৎকালীন সময়ে দেশের সেনাবাহিনীর ভেতর একটা বিরূপ মনোভাব ছিল। এর কারণ সেনাবাহিনিতে ধারণা ছিল. নব্য গঠিত বাহিনীর দিকে সরকারের বেশি মনোযোগ থাকার কারণে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বঞ্চিত হচ্ছে।
পাকিস্তান আমলে সেনাবাহিনী দুইবার দেশের ক্ষমতা দখল করে। একবার ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান, তারপর ১৯৬৮ সালে ইয়াহিয়া খান। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশেে যে সেনাবাহিনী ছিল সেটা পূর্ববর্তী ওই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অংশ। ফলে এই সেনাবাহিনী যে তাদের পূর্বসূরীদের মতো ঘটনা ঘটাবে না তার তো কোন নিশ্চয়তা নেই! এই অনিশ্চয়তাও রক্ষী বাহিনী গঠনের পেছনে একটি বড় কারণ হিসেবে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইব্রাহিম। তার মতে, যেহেতু ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এরকম ক্ষমতা দখলের কোন ইতিহাস নেই এই জন্যই মূলত ভারতীয় সেনাবাহিনীর আদলে গঠন করা হয়েছিল রক্ষী বাহিনী, এদের পোশাক ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতো, এদের প্রশিক্ষণ দিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা, এদের অস্ত্রশস্ত্র পোশাক আশাক সবকিছু আসতো ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে। সবমিলিয়ে এই বাহিনীর মন-মানসিকতা এমন ভাবে তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছিল যেন তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর মত হয় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতোই যেন কখনোই রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল না করে বা করার চেষ্টা না করে। সাথে সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনি থেকে উত্তরাধিকার সূ্ত্রে পাওয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে দেশের রাজনৈতিক সরকার কোন হুমকির সম্মুখীন হলে এই বাহিনী যেন প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে। সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম এর মতে, “এই বাহিনীকে যেসব প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, বেতার যন্ত্র ইত্যাদি দেয়া হচ্ছিল সেগুলো অত্যাধুনিক না হলেও, সেনাবাহিনীর তুলনায় আধুনিক।”
সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম জানিয়েছেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেক সমস্যা ছিল, যথেষ্ট পরিবহন ব্যবস্থা ছিল না, পোশাক ছিল না, জুতা ছিল না, এরকম একটা পরিস্থিতিতে আরেকটি নতুন বাহিনী তৈরি করে সেটাতে মনোযোগ দেয়া সাধারণ মানুষ এবং নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। এমনকি রক্ষীবাহিনিকে ইচ্ছেমত গ্রেপ্তার, তল্লাশীর অনুমতি দিয়ে বিশেষ আইন পাশ করা হয়েছিল। যেই আইন ব্যবহার করে রক্ষীবাহিনি দেশের মানুষের উপর নানা অন্যায় অত্যাচার করে যেটা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের কারণ হয়।
ইব্রাহিম আরও বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতের পর কার্যত কোন সরকার ছিল না। ২৪ শে আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের নির্দেশে সেনাপ্রধান হন জিয়াউর রহমান। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ তিন বছর চার মাস পনেরো দিন সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় রক্ষী বাহিনী বাংলাদেশের সবার চক্ষু সুল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দেশের ভালনারেবল অবস্থায় এই প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ভেঙে দেয়া খুব একটা ভালো সিদ্ধান্ত হতো না। কারণ ভেঙে দেয়া বিশৃঙ্খল বাহিনি, যারা সামরিকভাবে প্রশিক্ষিত তারা, দেশের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, নানানরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটাতে পারে। ফলে এই বাহিনীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে একীভূত করে ফেলা হয়।
Interview Link: https://youtu.be/aeNJl4AzrkY?si=uITHcQZ92oqJFGu1
Written By: Moheul Islam Mithu/Date Aug 20, 2024