প্রায় দুই শো বছর আগের কথা। ভারত উপমহাদেশে তখন ব্রিটিশদের শাসন চলছে। বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক জমিদারপুত্রকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর অভিযোগ আসলো জমিদারপুত্রের নিজের স্ত্রীর নামে। স্ত্রীর নাম ছিল হরসুন্দরী দেবী। হরসুন্দরী দেবী নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে স্বামীর সাথে সহমরণে গেলেন। গয়না গায়ে সিঁদুর দিয়ে বউ সেজে চিতায় উঠলেন। এরপর দুজনকে একসাথে সমাহিত করা হয়। সতীদাহ প্রথার চিহ্ন হিসেবে সেই সামাধি এখনও আছে ঝালকাঠি জেলার কীর্ত্তিপাশায়। তবে আমি যখন গিয়েছিলাম তখন আগাছায় ঢাকা অনেকগুলো ধ্বংসস্তুপের মধ্যে সেই সমাধি কোনটা সেটা আলাদাভাবে আবিষ্কার করতে পারিনি। মূলত এই ঘটনা থেকেই বৃহত্তর বরিশালের নাম হয় ‘সতীদাহের দেশ’। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার ১৮২৯ সালে আইন করে হাজার বছরের পুরোনো এই ভয়াবহ সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে। সেই ইতিহাস আমরা সবাই জানি। তবে আমার কথা শুনে মনে করার দরকার নেই যে ব্রিটিশ সরকারের সতীদাহ প্রথা বিলোপ আইন পাশ করার সাথে হরসুন্দরী দেবীর সতীদাহের ঘটনার সম্পর্ক খুব বেশি সম্পর্ক আছে। কারণ অমানবিক এই প্রথা বন্ধ করার জোর প্রচেষ্টা যে মুঘল আমল থেকেই চলে আসছিল, সেই প্রমাণ ইতিহাসে আছে। তবে সতীদাহ প্রথা আমার আজকের আলোচনার বিষয় নয়। আলোচনার বিষয় কীর্ত্তিপাশা জমিদারবাড়ি। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ আমার সোনার বাংলাদেশে খুবই কম, ব্যাপারটা বেদনাদায়ক। হরসুন্দরী দেবীর সমাধিটা আলাদাভাবে দেখে আসতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাবে সেটা করতে পারিনি।
বৃহত্তর বরিশালের জন্য এই কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়ির অনেকগুলো ভূমিকার কথা জানা যায়। বরিশাল বিভাগরে প্রথম নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয় এই কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়িতে। এই পরিবারের লোকজন বিভিন্ন সময় বরিশালের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তত্কালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কোলকাতায়। সময় টিভির একটা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “জমিদার পরিবারের নবকৃষ্ণ গাবখান নদী থেকে খাল খনন করে কীর্তিপাশা পর্যন্ত আনেন। নির্মাণ করেন রাস্তাঘাট। বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ শশী কুমার কীর্তিপাশায় দাতব্য চিকিৎসালয় নির্মাণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজকে সেখানে নার্সিং ইনস্টিটিউট চালু হয়েছে।” যদিও সময় টিভির প্রতিবেদনে গাবখানকে নদী বলা হচ্ছে, কিন্তু আমার জানামতে গাবখান একটা কৃত্রিম চ্যানেল। ১৯১৮ সালে সন্ধ্যা নদী আর সুগন্ধা নদীকে যুক্ত করার জন্য এই খাল খনন করা হয়। (অফটপিক: বৃহত্তর বরিশালের নদীর নামগুলো সুন্দর, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, ধানসিড়ি, জলাঙ্গী, বিষখালি, কীর্তনখোল। নাম শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়।) যাই হোক, যেই নার্সিং ইনস্টিটিউটের কথা বলা হচ্ছে, সেটা বর্তমানে জমিদার বাড়িটির ধ্বংসস্তুপের ঠিক বিপরীতে রীতিমত ঝলমল করে। সময় বড় অদ্ভুত জিনিস, পৃথিবী খুব কঠিন জায়গা। কাকে রাখবে আর কাকে কালের গহ্বরে তলিয়ে যেতে দেবে, বোঝা বড় দায়। যেই বাড়ির উদ্যোগে দাতব্য চিকিত্সালয়ের গোরাপত্তন সেই বাড়ি এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন, আর ‘তখনকার করুণার’ দাতব্য চিকিত্সালয় এখন সদর্পে দাড়িয়ে থাকা বিরাট এক আধুনিক প্রতিষ্ঠান। নবকৃষ্ণ মহাশয়ের খনন করা সেই খালটাও এখনও আছে, সেটার উপর সুন্দর লালসাদা চকচকে সেতু শোভা পায়।
বরিশাল বিভাগের অনলাইন ডিরেকটরি বলছে, কীর্ত্তিপাশায় একটা হাসপাতাল আছে, এই হাসপাতাল ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের চেয়েও পুরোনো। মহাসড়ক থেকে জমিদার বাড়িতে যাওয়ার পথে একটা ছোট ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল চোখে পড়েছিল, সেটার কথাই বলা হচ্ছে কিনা নিশ্চিত নই। কিন্তু ছোট্ট হাসপাতালের আগাছা দেখে মনে হয়নি, এখানে খুব বেশি মানুষের যাওয়া আসা আছে।
জমিদার বাড়িটা এখনকার ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নে অবস্থিত। কীর্ত্তিপাশা নামটা সুন্দর। নামটা এসেছে রাজা কীর্তি নারায়নের নাম থেকে। কিন্তু জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পাওয়া যায় রামজীবন সেনের নাম। এই রামজীবন সেনের সাথে রাজা কীর্তি নারায়নের সম্পর্কটা কী সেটা জানতে ইচ্ছা করছে। এই বংশের আরও দুই জনের নাম বিভিন্ন জায়গায় দেখলাম, রোহিনী রায়চৌধুরী ও তপন রায়চোধুরী। গাবখানের তীরের স্টিমারঘাট স্থাপনে তপন রায় চৌধুরীর অবদান রয়েছে। এই বংশের বংশলতিকাটা পেলে ভালো হত। কখনও সময় পেলে হয়তো খুজে দেখব। কারও জানা থাকলে আর সময় সুযোগ পেলে অবশ্যই জানাবেন। (Email: moehulimithu@gmail.com)
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন তপন রায়চৌধুরী। ভদ্রলোক ২০১২ সালে মারা গেছেন। ডেইলি স্টারে প্রকাশিত আহমেদ ইশতিয়াকের লেখা থেকে জানতে পারলাম, তপন রায় চৌধুরী নিজের আত্মস্মৃতি ‘বাঙালনামা’ ও ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা’ গ্রন্থে তার সময়ের কীর্তিপাশার ব্যাপারে অনেককিছু তুলে ধরেছেন। বইদুটো পড়ে ফেলতে হবে, কারণ যতদূর বুঝছি বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ নিয়ে নিয়ে এই দুই বই বিরাট উপাদেয় কিছু। রায় চৌধুরীর বর্ণনায় জানা যায়, কীর্ত্তিপাশা গ্রামের নামটা সত্যিই এসেছে রাজা কীর্ত্তি নারায়ণের নাম থেকে। তপন রায় চৌধুরীর পূর্বপুরুষ কৃষ্ণকুমার সেন আঠারো শতকের কোনো এক সময় রায়কাঠির রাজার কাছ থেকে পুরস্কার হিসেবে কীর্ত্তিপাশা গ্রামে তালুক পেয়েছিলেন। নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজারাম সেন ও কনিষ্ঠ পুত্র কাশীরাম সেনের নামে তালুক কিনেছিলেন কৃষ্ণকুমার সেন। রাজারাম পেয়েছিলেন সম্পত্তির দশ আনা। আর কাশীরাম পেয়েছিলেন ছয় আনা। সেই থেকে দুজন গড়ে তুলেছিলেন দুটি দালান। বড় ছেলের জন্য ১০ আনা বড় হিস্যা জমিদার বাড়ি। আর ছোট ছেলের জন্য ৬ আনা ছোট হিস্যা জমিদার বাড়ি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ছোট হিস্যা জমিদার বাড়ি অনেক আগেই ধ্বংস হয়েছে, এখন যে ধ্বংসপ্রায় বাড়ি দেখা যায় সেটা বড় হিস্যা জমিদার বাড়ি।
বর্তমানে জমিদার বাড়ির একটি অংশে রয়েছে প্রসন্নকুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন স্কুল খোলা ছিল। জমিদার বাড়ির অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে কোরিডোর থেকে ছাত্রদের কিচিরমিচির শুনতে পাচ্ছিলাম। আর লেখার শুরুর দিকে বরিশালের যে প্রথম নাট্যমঞ্চের কথা বলেছিলাম, সেই নাট্যমঞ্চ এখন নবীনচন্দ্র মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়।
আমার ইটিউব চ্যানেলে কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়ি নিয়ে একটা ভিডিও আছে। সময় থাকলে দেখে নিতে পারেন।
তথ্যসূত্র:
১. https://www.jhalakathi.gov.bd/bn/site/page/uWxZ-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%80%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A4-%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A3%E0%A6%A8%E0%A6%BE
২. https://www.somoynews.tv/news/2022-06-13/%E0%A6%95%E0%A7%80%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%80%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BF
৩. https://adarbepari.com/kirtipasha-zamindar-bari-jhalokathi
৪. https://vromonguide.com/place/kirtipasha-zamindar-bari
৫. https://www.barisaldiv.gov.bd/bn/site/tourist_spot/O73V-%E0%A6%95%E0%A7%80%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B6%E0%A6%BE-%E0%A6%9C%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A1%E0%A6%BC%E0%A7%80
6. https://www.prothomalo.com/fun/y1dwcvbbc1
৭. https://bangla.thedailystar.net/literature/history-tradition/history/news-459161