গত ৫ আগস্ট শেখ হসিনা পালানোর পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে ড. মুহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে। বিএনপি সহ সবগুলো রাজনৈতিক দল তাদের সমর্থন জানিয়েছে এবং সুষ্ঠ নির্বাচন আয়োজন করার জন্য সবরকম সহযোগিতা করার কথা বলেছে।
গণ আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের সরকারের বিদায়ের ফলস্রুতিতে আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের শরীক দলগুলো ছাড়া সব রাজনৈতিক দলই এখন সক্রিয়, তারা নিয়মিত মিটিং, সমাবেশ করছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন। বড় দলগুলোর শীর্ষনেতারা এখন নিয়মিত পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছেন।
এরমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। যদিও দলের শীর্ষ নেতারা বলার চেষ্টা করছেন, তাদের দল এইসব চাঁদাবাজি, দখলবাজি সমর্থন করে না, এরকম দুএকটা ঘটনা ঘটলেও সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তবুও দিন যাওয়ার সাথে সাথে অভিযোগের পরিমাণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ দুই দলের রাজনীতি চলে, আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। একবার এই দল ক্ষমতায় আসে, আরেকবার অন্য দল। গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে মাঠে এখন দল একটাই। বিএনপি। তারা সম্ভবত ধরেই নিয়েছে যে এরপর তারা রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসছে। এইজন্য এতদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগে আওয়ামী লীগের নেতারা চাঁদাবাজি করত, এখন তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে সেটা বিএনপির অধিকার বলে ধরে নেয়া হয়েছে সম্ভবত।
গত ৩১ আগস্ট বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “বিএনপির নামে কেউ চাঁদাবাজি
করতে আসলে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিন।”
দলটির যুগ্ম মহাসচিব এমরান সালেহ প্রিন্স বলেছেন, “দখলবাজি-চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস বিএনপির অভিধানে নেই।”
কিন্তু তাদের নেতাদের চাঁদাবাজির সংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রতিদিনই আসছে।
৩১ আগস্ট ঢাকা পোস্ট নিউজ করেছে, বরিশালে বিএনপি নেতার নামে চাঁদা না দেয়ায় থ্রি-হুইলার চালকদের মারধর করেছে মহানগর বিএনপি এক নেতার লোকজন। সংবাদে বলা হয়েছে, অনেক লোক মিলে থ্রি-হুইলার চালকদের উপর হামলা করেছে এবং আট-দশটা গাড়ি ভাংচুর করেছে। খবরটা পড়ে বোঝা যায়, ব্যাপারটা বেশ সংঘবদ্ধভাবেই করা হয়েছে, ব্যাপারটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।
আগস্ট ১৫, ২০২৪ তারিখে বিবিসিতে খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও বিএনপির নেতা পরিচয়ে চাঁদাবাজির কথা বলা হয়েছে। দোকানে চাঁদাবাজির পাশাপাশি গারমেন্টস ফ্যাক্টরির ঝুট ব্যবসা দখল করার খবর প্রকাশিত হয়েছে।
আবার ৩১ আগস্ট ২০২৪, সময় নিউজে প্রকাশিত হয়েছে, দৌলদিয়ায় চাদাবাজি করছে বিএনপি নেতা। সেই অভিযোগ করেছে আবার বিএনপির অন্য আরেকটি গ্রুপ। সংগতকারণেই সচেতন নাগরিকের মনে হতে পারে, এ অভিযোগ মূল আধিপত্য বাড়ানোর জন্যই করা হয়েছে।
সিরাজগজ্ঞে চাঁদাবাজির অভিযোগে তিন বিএনপি নেতাকে শোকজ নোটিশ পাঠিয়েছে জেলা বিএনপি। আবার ৩০ আগস্ট ২০২৪ এর খবর, মামলা থেকে আওয়ামী লীগ নেতার নাম বাদ দেয়ার জন্য চাঁদা দাবি করেছে বিএনপির এক নেতা।
আজ ১ সেপ্টেম্বর চ্যানেল ২৪ এর ওয়েবসাইটে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, বরগুণার আমতলী উপজেলায় বিএনপির এক নেতার বিরূদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে মানববন্ধন করেছে এলাকাবাসী।
যখন এই লেখাটা লিখছি তখন এরমধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দীন আবার এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন গাড়িতে সংবর্ধনা নিচ্ছেন বলে প্রথম আলো খবর প্রকাশ করেছে। এব্যাপারে সালাউদ্দীন সাহেব বলেছেন, কার গাড়িতে উঠেছেন জানেন না, শুধু জানেন গাড়ি যে চালিয়েছে সে দীর্ঘদিন সালাউদ্দীন সাহেবদের পারিবারিক ড্রাইভার। খবরটা ইন্টারেসি্টং, সেখানে বলছে, এস আলম গ্রুপের অনেকগুলো দামী গাড়ি বিএনপির নেতাকর্মীদের দায়িত্বে আছে। খবরটার কিছু অংশ উদ্ধৃত না করে পারছি না, “এদিকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নগরের কালুরঘাট এলাকার একটি কারখানা থেকে বিলাসবহুল কয়েকটি গাড়ি বের হওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায়, একটি কারখানা থেকে একের পর এক দামি গাড়ি বের হচ্ছে। সেখানে কয়েকজন ব্যক্তি তা তদারক করছেন। যাঁরা ভিডিওটি শেয়ার করেছেন, তাঁদের ভাষ্য, এগুলো শিল্প গ্রুপ এস আলমের গাড়ি এবং যাঁরা তত্ত্বাবধানে আছেন, তাঁরা বিএনপির নেতা-কর্মী। এ ঘটনার পর দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানসহ তিন নেতাকে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছে দলটি।”
এছাড়াও বিএনপির বিরূদ্ধে চাঁদাবাজির আরও অনেক অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত আড্ডায় শোনা যাচ্ছে। সেসবের বিশ্বাসযোগ্যতারও যথেষ্ট কারণ আছে।
অপরাধ করে ধরা পড়ার পর অপরাধী আমাদের দলের কেউ নয়, তাদের বিরূদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে, ব্যক্তির অপরাধের দায় পুরো দল নেবে না, এসব কথা এর আগেও বহুবার শুনেছি আমরা। আগস্ট মাসের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকার যাওয়ার পর বিএনপির কাছ থেকেও শুনছি। কিন্তু এখনও কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার খবর পাওয়া যায়নি, অন্তত আমরা পাইনি।
যদি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দাবিই সঠিক হয়, চাঁদাবাজির অভিযোগ যাদের বিরূদ্ধে তাদের সাথে সংগঠনটির সম্পর্ক নাও থাকে, তবুও কেন্দ্রীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া উচিত, অভিযুক্তদের সাথে যে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই সেটা প্রমাণ করা দায়িত্ব তাদেরই। আবার যদি অভিযুক্তদের সাথে সম্পর্ক থেকেই থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে তাদের নেতাদের বিরূদ্ধে এমন অভিযোগও না আসে।
জুলাই মাসে ছাত্র-জনতা যে আন্দোলন করেছে সেটা শুধু সরকারের বিরূদ্ধে ভাবলে ভুল হবে, যে অশুদ্ধতা, অনাচার, সমাজের গেড়ে বসেছিল সেসবের বিরূদ্ধেও। এখন বিএনপি যদি সেই পুরোনো ব্যবস্থা থেকে নিজেদের বের করে না আনে তাহলে আজ হোক বা কাল হোক, এই ঐতিহ্যবাহী দলটার অবস্থাও সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগের মতই হবে।
তাই নিজেকে আস্তিত্বের স্বার্থেই বিএনপির উচিত, সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া এবং সেটা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা।
কারণ দল যাবে দল আসবে ক্ষমতা যাবে ক্ষমতা আসবে, জনতা থাকবে। আর জনতাই সবকিছুর কেন্দ্র। তারা নাটক দেখে কিন্তু তাদেরও সহ্যের সীমা আছে। আর ২০২৪ এর আন্দোলন তাদের যে শিক্ষা দিয়েছে তাতে অন্যায় অনাচার দুঃশাসনের বিরূদ্ধে তাদের সহ্যসীমা খুব করে গেছে বলেই মনে হয়।
এটা নিয়ে একটা ভিডিও বানিয়েছি, দেখতে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে:
এই লেখা পাবলিশ করার পরে একটা আপডেট এসেছে, লিখে রাখাটা দরকার তাহলে পরিস্থিতি আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে।
আপডেট:
চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ-এস আলম গ্রুপের গাড়ি-কাণ্ডে বিএনপি থেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। একটা বিতর্কিত ঘটনায় এত দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে ঠিক কাজটাই করেছে বিএনপি। অন্তত লোক দেখোনোর জন্য হলেও সঠিক কাজটা করেছে।
অবশ্য গাড়ি-কাণ্ড এরমধ্যেই ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল।এজন্যই সম্ভবত বিব্রত হয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। একটাও ভালো ব্যাপার। এর আগে অনেকগুলো দেশ নাড়িয়ে দেয়া ঘটনায় আওয়ামী লীগ বা সরকারের হাইকমান্ডকে বিব্রত হতে দেখিনি আমরা।
Sources:
https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/5ewabbp3hp
https://www.dhakapost.com/country/303302
https://www.somoynews.tv/news/2024-08-31/NCExEZMw
https://www.bbc.com/bengali/articles/cje2w2kw850o
https://bangla.bdnews24.com/samagrabangladesh/a721adfeda00
https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/9ejg6wtupy