সিরিজ: কন্ট্রাক্টসাল: ২০২১পরিচালনা: তানিম নূর ও কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়কাহিনি: মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনঅভিনয়: আরেফিন শুভ, চঞ্চল চৌধুরি, মিথিলা, তারেক আনাম, শ্যামল মওলা প্রমুখ
হ্যারিসন ফোর্ড অভিনীত ‘ইন্ডিয়ানা জোনস’ সিরিজের সিনেমাগুলো দেখার পর আমার এতই ভালো লেগেছিল যে পরে এই সিরিজের বুক অ্যাডাপ্টেশনগুলোও আমি পড়ে ফেলেছিলাম। তারমানে সিনেমা ভালো হলে বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ে। অন্তত বাংলাদেশে অবশ্যই। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বোধহয় ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ। সিরিজের শেষ বইটা অনুবাদ হওয়ার পর সেবছর বইমেলায় ভ্যান থেকেই বই বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল, স্টলে নেয়ারও সময় পাচ্ছিলেন না স্টলের লোকজন।
কিন্তু মিসির আলী সিরিজের সবচেয়ে ভালো বইগুলোর একটা ‘দেবী’ নিয়ে সিনেমা হওয়ার পর মিসির আলীর ব্যাপারে সবার আগ্রহ বেড়েছে বলে কোনোদিনই মনে হয়নি। কারণ সিনেমাটা আসলে বইয়ের স্বত্ত্বাটাকে তুলে আনতে পারেনি। সিনেমাটা দেখার পর আমার যেটা মনে হয়েছে, সেটা হল, হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা আর মিসির আলীর নাম ব্যবহার করে মানুষের এটেনশন গ্যাদার করার একটা চেষ্টা। যে চেষ্টা প্রাথমিকভাবে কিছুটা সফল হলেও ধোঁয়াশা কেটে যাবার পর ব্যর্থ হয়েছে। আর তাছাড়া আমাদের দেশীয় সিনেমায় কাহিনি জিনিসটাই পাওয়া যায় না, সেখানে অ্যাডপশনটা কাহিনি খোঁজার কঠিন কাজটার একটা সহজ সমাধান বৈকি। অর্থাৎ আমাদের নির্মাতাদের লাভটা দুই দিক থেকে, কাহিনিও খুঁজতে হল না, আবার অল্প খরচে লোকজনের অ্যাটেনশনও পাওয়া গেল।
মোহাম্মদ নাজিমুদ্দীনের লেখা জনপ্রিয় বেগ-বাস্টার্ড সিরিজের ‘কন্ট্রাক্ট’-এর ওয়েব সিরিজ অ্যাডাপশনটার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেরকমই মনে হল। ওয়েব সিরিজটা বেগ-বাস্টার্ড সিরিজ, নাকি রঞ্জু-বাস্টার্ড সিরিজ সেটা নিয়েই চিন্তায় পড়ে গিয়েছি। বইটা আমি ৬-৭ বছর আগে পড়েছিলাম। কাহিনি অনেকটাই মনে নেই। কিন্তু শুধুমাত্র শুরুর দিকের উমা আর টাকার কাহিনি ছাড়া আর কোথাও কোনো মিল আছে বলে তো মনে হল না। বইয়ের পাত্রপাত্রীর নাম ব্যবহার করা ছাড়া আর কিছু নেয়া হয়েছে বলে তো মনে হল না। কন্ট্রাক্ট বইটা পড়ার পরে লেখকের লেখার ব্যাপারে আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু আমি যদি বইটা পড়ার আগেই এই ওয়েব সিরিজ দেখতাম তাহলে ‘কন্ট্রাক্ট’ বইটা পড়ার কোনোরকম আগ্রহ তৈরি হত না নিশ্চিত। অর্থাৎ বইয়ের কাহিনির (অন্তত কাহিনির সিংহভাগ) জীবন্ত রূপান্তর দেখার যে আগ্রহ নিয়ে স্ক্রিনের সামনে বসেছিলাম সেটা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
শুধু ওয়েব সিরিজ হিসেবেও যদি চিন্তা করি তাহলেও কাজটাকে দর্শক হিসেবে খুব একটা ভালো বলতে মন চায় না। পুরো সিরিজ জুড়ে একদিকে হিরো অনেক হম্বিতম্বি করলেন, অন্যদিকে এন্টিহিরোও অনেক হম্বিতম্বি করলেন, এবং শেষে গিয়ে খুব সিগনিফিকেন্ট কিছু ঘটতে দেখা গেল না। অন্যদিকে হিন্দি ‘রাজনীতি’ সিনেমার আদলে গরীরের ক্যাটরিনা কাইফ হয়ে এলেন সুন্দরী মিথিলা। অনেকদিকে অনেক ঘটনা ঘটতে লাগত। ঘটতে ঘটতে শেষের দিকে আসল এবং অতপর সকলেই সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিত। কিন্তু পূর্বে দেখানো অনেক ঘটনার পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই বোধগম্য হল না। বিশেষকরে রাজনীতি নিয়ে যে অনেক কাহিনি দেখানো হল, এই সিরিজের মূল কাহিনিতে সেটার কন্ট্রিবিউশন তো পেলাম না। আর জেফরি বেগের ইনভেস্টিগেশনটা তো শুধু প্যারালাল ঘটনা ছাড়া কিছু মনে হল না।
যাইহোক, ওয়েব সিরিজ দেখার পুরো সময়টা নষ্ট হয়েছে বলব না। শেষ এপিসোড পর্যন্ত আগ্রহ জিইয়ে রাখার ক্রেডিটটা দিতেই হবে। আর সবার অভিনয়ও ভালো ছিল।
কিন্তু একটা ভালো বইয়ের প্রতি একদমই জাস্টিস করা হয়েছে বলে মনে হয়নি। বইয়ের পছন্দের চরিত্রগুলোর নাম ব্যবহার করা হয়েছে। সম্ভবত ব্যবসা আর অ্যাটেনশন পাওয়ার উদ্দেশ্যে। এমনকি সুন্দর এই চরিত্রগুলোর প্রতি নির্মাতাদের ভালোবাসারও যথেষ্ট কমতি ছিল বলেই মনে হল।
সাহিত্যকে সিনেমায় ব্যবহার করার প্রচলন অনেক পুরোনো। বাংলাদেশের যাচ্ছেতাই সিনেমার বাজার যদি সাহিত্যকে আঁকড়ে ধরে কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে চায় তাহলে দোষের কিছুই নেই। খুশির কথা। কিন্তু বড় বড় নামগুলো ব্যবহার করে এমন লেজে-গোবরে করলে ভক্তদের মনে অশান্তি আরও বাড়ে। এটাই সমস্যা।