আমার প্রিয় জেনগল্প: পাঁচটি সময়ে নীরব থাকুন

আমার প্রিয় জেনগল্প

অনেক অনেকদিন আগের কথা। পর্বতের ঢালে ছিল এক জেন আশ্রম। সেই আশ্রমে থাকতেন এক মহাজ্ঞানী জেন গুরু। অনেক অনেক দূর থেকে মানুষজন আসতো তার দীক্ষা নিতে, তার কথা শুনতে, তার গভীর জ্ঞানের ভান্ডার থেকে নিজেদের ঋদ্ধ করতে।

একদিন আশ্রমের এক তরুণ ছাত্র জেন গুরুকে জিজ্ঞেস করল, “গুরুজী, সত্যিকারের পরিপূর্ণ জীবনের রহস্য কী? সত্যিকারের অর্থপূর্ণ জীবন আসলে কেমন?”

মহাজ্ঞানী জেন গুরু মুচকি হেসে বললেন, “বত্‌স, আজ তোমাকে পাচটি পরিস্থিতির কথা বলব, যে পাঁচ পরিস্থিতিতে নীরবতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে পরিপূর্ণ আর অর্থপূর্ণ জীবনের গভীর জ্ঞান।এই পাঁচ পরিস্থিতিতে নীবর থাকতে পারলে আত্মিক শান্তির সন্ধান মিলবে। আর আত্মার প্রশান্তি ক্রমান্বয়ে নিয়ে যাবে পরিপূর্ণ আর অর্থপূর্ণ জীবনের দিকে।”

প্রথম পরিস্থিতি হল, রাগ উঠলে নীরব থাকবে।

জেনগুরু ব্যাখ্যা করলেন, ক্রোধ বা রাগ হল মেঘের মত। সেই মেঘ যখন আমাদের ভেতরে মাথাচারা দিয়ে ওঠে তখন আমাদের বিচারবুদ্ধি আর আত্মার প্রশান্তি সেই মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। সেই মুহূর্তে  ঝোঁকের বশে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নীরব হয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। প্রচণ্ড রাগের মুহূর্তে আমরা এমন অনেককিছু বলে ফেলি বা করে ফেলি যার জন্য পরে আফসোস করতে হয়। ওই সময়ে নিজেকে সংযত করে নীরব থাকলে সত্যিকারের জ্ঞানীর মত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

দ্বিতীয় পরিস্থিতিটা হল, তর্কের সময়।

জেনগুরু আবার ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন, “আমরা যখন তর্কে লিপ্ত হই তখন আমরা প্রায়শই বৃহত্‌ পরিস্থিতিকে দেখার অন্তর্দৃষ্টিটাকে হারিয়ে ফেলি। এমন সময় নীরব থাকার মাধ্যমে আমরা আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে আরও বিস্তৃত করতে পারি, এবং চুপচাপ থেকে যার সাথে তর্ক চলছে সেই মানুষটার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করতে পারি। এতে করে আমরা যেমন অপর মানুষটার অবস্থানটা বুঝতে পারব, ঠিক তেমনই নিজের অবস্থানের ফাঁকফোঁকড়গুলোও আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে। আর এতে করে সব পক্ষই লাভবান হবে।”

তৃতীয় পরিস্থিতি, “প্রচণ্ড দুঃখের সময় নীরব থাকবে।”

কিছুক্ষণ নীরব থেকে জেনগুরু বুঝিয়ে বলতে শুরু করলেন, “দুঃখ জীবনের অংশ। দুঃখ বা কষ্টের মুহুর্তে নীরব থাকলে, সেই কষ্টের শিক্ষা আমাদের ভেতরে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিতে পারে, আবেগের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে সাহায্য করে।নিজের কষ্টের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেয়ে তাকে পরম আদরে গ্রহন করতে শেখায়।আরও দৃঢ়ভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগায়।”

be silent in five situations. zen story

চার, “অনিশ্চয়তার মুহূর্তে নীরব থাকবে।”

মহাজ্ঞানী গুরু এবার একটু থামলেন। তরুণ ছাত্রের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকালেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলতে শুরু করলেন, “মানুষের জীবন অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। এই সব দ্বন্দ্ব আর অনিশ্চয়তার মুহূর্তে, একমাত্র নীরবতাই পারে আমাদের মনকে শান্ত করতে, স্থিরতা দিতে। একান্ত নিসঙ্গতা আর নীরবতার মধ্যে দিয়ে আমরা মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা সমাধানের সন্ধান পেতে পারি। নীরবতা আর ধ্যানের মধ্যে দিয়ে সেই সকল অনিশ্চয়তা আর দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারি।”

এবার তরুণ ছাত্রের চোখ থেকে জিজ্ঞাসা বিদায় নিলে জেনগুরু পঞ্চম পরিস্থিতির কথা বললেন, “সফলতার সময় নীরব থাকবে।”

“চরম সাফল্য আর আনন্দের মুহূর্তেও নীরব থাকার কোনো বিকল্প নেই। সফলতার মুহূর্তে অসাবধানতা বশত ঔদ্ধত্য হয়ে ওঠা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। আর ঔদ্ধত্য টেনে আনে আত্মপ্রসাদ, আর আত্মপ্রসাদ আনে ধ্বংস।নীরবতা আমাদেরকে এই সফলতার সময়ে অবনত আর বিনীত থাকতে সাহায্য করে।”

এতক্ষণ জেনগুরুর কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার পর তরুণ ছাত্র বুঝতে পারল, নীরবতার অর্থ শুধু আওয়াজ বা শব্দের অনুপস্থিতি নয়, নীরবতার অর্থ আরও গভীর। এই নীরবতা নিজেকে পরিপূর্ণ করে তোলার এক শক্তিশালী হাতিয়ার। 

সংগ্রহ ও অনুবাদ: মহিউল ইসলাম মিঠু
তারিখ: ২৪ আগস্ট ২০২৩
সাভার, ঢাকা।

গল্পটা এখান থেকে শুনতে পারেন।

Author: Moheul I Mithu

মহিউল ইসলাম মিঠু কৌতুহলী মানুষ। জানতে ভালোবাসেন। এজন্যই সম্ভবত খুব অল্প বয়সেই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। পড়ার অভ্যাসটাই হয়তো ধীরে ধীরে লেখার দিকে ধাবিত করেছিল। তার পাঠকপ্রিয় অনুবাদ গুলোর মধ্যে রয়েছে: দি হবিট, দি লর্ড অফ দ্য রিংস, পার্সি জ্যাকসন, হার্ড চয়েসেজ, দি আইস ড্রাগন, লিজিয়ন, প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে, দি আইভরি চাইল্ড ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রথমসারির জাতীয় পত্রিকা, সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইটের জন্য লিখেছেন বিভিন্ন সময়। তিনি বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন কিশোর-ম্যাগাজিন ‘আজবদেশ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। বিশ্বখ্যাত ২০টির বেশি বই অনুবাদ করে বিভিন্ন স্তরের পাঠকের আস্থা অর্জন করেছেন, জিতে নিয়েছেন ভালোবাসা। তার অনুদিত কিছু বই বিভিন্ন সময় জাতীয় বেস্ট-সেলারের তালিকাগুলোতে ছিল। (লিখেছেন: লে: কর্নেল রাশেদুজ্জামান)

Share This Post On

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link
Powered by Social Snap