অনুবাদকের কথা
লর্ড অফ দ্য রিংসের সাথে আমার পরিচয় ২০০৪ সালে। এই সিরিজের তৃতীয় সিনেমা ‘রিটার্ন অফ দ্য কিং’ রিলিজ হওয়ার পর। আমি তখন ক্লাস সিক্সে। টাংগাইলে থাকতাম। ভিক্টোরিয়া রোডের একটা ভিসিডির দোকান থেকে সিনেমার ভিসিডিটা কিনে দিয়েছিল আম্মু। তখন বাংলাদেশে ভিসিআর থেকে ভিসিডিতে ট্রানজেশনের সময় চলছিল। একই দোকানে ভিসিআর, ক্যাসেট, ভিসিডির ডিস্ক বিক্রি চলত। শহরাঞ্চলে অনেকের বাসায় ভিসিডি প্লেয়ার ঢুকতে শুরু করেছে, আর গ্রামে তখনও ভিসিআর। ডিভিডি আসতে তখনও অনেকটা দেরি।
তখন সিনেমাটা দেখে কতটুকু কী বুঝেছিলাম সেটা মনে করতে পারি না। কিন্তু গ্যান্ডালফ, অ্যারাগর্ন, গলাম আর ফ্রোডোকে খুব ভালো লেগেছিল। এরপর যখন জানলাম এই সিনেমার আরও দুইটা পর্ব আছে তখন সেগুলোও কালেক্ট করে দেখা হল। তখন সিনেমা এখনকার মত এত সহজলভ্য ছিল না। দি লর্ড অফ দ্য রিংসের আগের দুটো পার্ট কালেক্ট করতে অনেকদিন লাগল। ঢাকা থেকে কিনে নিয়ে যেতে হল। রিটার্ন অফ দ্য কিং দেখা পর ততদিনে বছর খানেক কেটে গেছে। টাঙ্গাইলের পাট চুকিয়ে সিরাজগঞ্জে থাকতে শুরু করেছি। স্কুল পাল্টে গেছে, বন্ধুবান্ধব পাল্টে গেছে, শুধু মুভির জন্য অপেক্ষা পাল্টায়নি। এখনকার ক্লাস সিক্সে পড়া ছেলেমেয়েরা কী এটা কল্পনাও করতে পারবে? সিনেমা দেখার জন্য এক বছর অপেক্ষা! এখন নিজেরই কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে।
যাই হোক, সিরিজের প্রথম সিনেমাটা দেখার পর সেই যে ভয়াবহ ফ্যান হলাম মিডলআর্থের তারপর থেকে এখনও চলছে। তারপর থেকে বহুবার দেখা হয়েছে এই সিরিজ। কিন্তু ছোটবেলার ভালোবাসা বলে কথা, কমে তো না-ই, দিনে দিনে আরো তীব্র হয়।
এরপর ঘটনা ২০০৮ বা ২০০৯ সালে। ততদিনে সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়াতে চলে এসেছি। বগুড়ায় বইমেলা চলছিল। তখন বগুড়ার বইমেলা বসত জেলা স্কুলের সামনে। এখন কোথায় বসে জানিনা। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে দি লর্ড অফ দ্য রিংসের বই প্রথমবারের মত আবিষ্কার করলাম। কিনে ফেলতে দেরি করিনি। কিন্তু পড়তে পারিনি। সেটা অন্যগল্প, কিন্তু এখানে বলা যাবে না। মেলা থেকে কেনা ওই বইটা পড়তে না পারলেও কিছুদিন পরই লর্ড অফ দ্য রিংসের নীলক্ষেত কপি সংগ্রহ করে পড়ে ফেললাম। তখন অনেককিছুই বুঝিনি। কাহিনী, অ্যাকশন, ফ্যান্টাসি, এগুলোর জন্যই ভালো লেগেছিল। কিন্তু এসবের বাইরেও কিছু ছিল যেটার জন্য পরেও অনেকবার টোলকিনের এই মাস্টারপিস পড়তে বাধ্য হয়েছি।
অনেকবার মানে আসলেই অনেকবার। মাঝে মাঝে একটু ফুসরত পেলেই আমি যেই বই এবং মুভিগুলো বারবার দেখি এবং দেখতে ভালোবাসি তার মধ্যে লর্ড অফ দ্য রিংস সিরিজ একটা। এরমাঝে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে মিডলআর্থের কাহিনী নিয়ে নাড়াচাড়া করা হয়েছে।
২০১৩-১৪ তে “দি হবিট” অনুবাদ করার সময় মিডলআর্থ নিয়ে বেশ ভালোরকম নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। দি হবিট অনুবাদ করাটা একটু দুঃসাহসের পরিচয় হলেও, কাজটা শেষ হওয়ার পর আমি জানতাম, আমি এই পুরো সিরিজটা অনুবাদ করতে চাই। ভালো হোক আর খারাপ হোক, শেষ করব। (আর, সত্যি বলতে, একটা আত্মবিশ্বাস ছিল, খারাপ হবে না। কারণ ততদিনে ‘দি হবিট’ দিয়ে অনেকের ভালোবাসা পেয়ে গিয়েছিলাম)। এই চাওয়ার তীব্রতাটা এমন যে, এই সিরিজটা শেষ না করে যদি মরে যাই তাহলে প্রচন্ড একটা আফসোস থাকবে।
বছরখানেক আগে বেশ ভালোরকম অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। অসুস্থতার মাঝে মাঝে ভয় লাগত, মরে-টরেই যাই কিনা! তখন খুব মনে হয়েছিল, “আহারে আমার লর্ড অফ দ্য রিংস সিরিজটা শেষ করা হয়নি। সুস্থ হলে কাজ ধরব আবার।”
হবিট প্রকাশিত হওয়ার পর লর্ড অফ দ্য রিংসের কাজ শুরু করতে অনেকদিন দেরি করলাম। কারণ অনেকগুলো সেসব এখানে বলতে চাই না। হয়তো অন্য কোথাও বলব।
অনেকবার অনুবাদ ছেড়ে দেয়ার কথা ভেবেছি। কিন্তু সেই অসুস্থতার পর থেকে আমি জানতাম, অনুবাদ যদি ছেড়েও দিই, এই সিরিজ শেষ করে ছাড়ব। যদি শুধু বেঁচে থাকি, সৃষ্টিকর্তা সাহায্য করেন।
তবে কাজটা সহজ হবে না। সবকিছু মিলিয়ে প্রায় পনেরশ পেজের বিশাল ব্যাপ্তির এক মহাকাব্যিক কল্পনার জগৎ, সাথে টোলকিনের গল্প বলার স্টাইল, তার উপর গল্পের মাঝে অসংখ্য ছড়া, গান, কবিতা। সাথে কিছু অসাধারণ হিউমার আর ডিপ-উইজডম যেগুলো ইংরেজিতেই সুন্দর, অন্য ভাষায় রূপান্তর করলে মজাটা আর থাকে না, বা কমে যায়। সবমিলিয়ে খুব কঠিন একটা কাজ। কিন্তু জীবনে একটা বড় কাজ থাকা উচিত। অনুবাদ যখন করেইছি, একটা ভালো কাজ থাক যেটা নিজের প্রায় সবটুকু উজাড় করে দিয়ে করা হবে।
যাইহোক, আসল কথায় আসি। লর্ড অফ দ্য রিংসের সাথে চলাফেলার তো প্রায় ১৫-১৬ বছর হয়ে গেল। খুব কম সময় নয়। এই সময়ে আমি যেটা সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করেছে সেটা হল, লর্ড অফ দ্য রিংসের কাহিনি কল্পনা বর্ণনা এগুলো তো শক্তিশালীই, কিন্তু এর সবচেয়ে শক্তিশালী দিকটা হল এর ফিলোসফি। ইটস লেস অ্যাবাউট দ্য স্টোরি ইটসেলফ, মোর অ্যাবাউট ইটস ফিলোসোফি। প্রতিটা চরিত্র, চরিত্রগুলোর নিজস্ব একেকটা গল্প, তাদের আলাদা আলাদা চিন্তা-ভাবনা, আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি, এই সবকিছুই টোলকিনের লেখনীর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। এই দিকগুলোই আমাদের অসংখ্য সম্ভাব্য বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, যেগুলো আমাদের জীবনদর্শনকে আরও পূর্ণতা দেয়, পৃথিবীকে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে শেখায়। এজন্যই হয়তো লর্ড অফ দ্য রিংস-এর পৃথিবী কাল্পনিক (কারও কারও মনে অবাস্তব, গাজাখুড়ি, বাচ্চাদের কাহিনী!) হলেও এর আবেদন যেন বাড়তেই থাকে, কমে না।
গল্পের নায়ক ফ্রোডোকে আমরা গল্পের শুরুতে যেভাবে পাই, গল্পের শেষে গিয়ে উপলব্ধি করি সেই ফ্রোডো পাল্টে গেছে। মিডলআর্থের স্বাধীন জাতিগুলোকে রক্ষার লড়াই তাকে আপাদমস্তক বদলে দিয়েছে। এই গল্পে আমরা বন্ধুত্ব দেখি, আত্মত্যাগ দেখি, আদর্শের জন্য পার্থিব সব স্বার্থকে তুচ্ছ করতে দেখি। আবার সব থাকার পরেও শুধু লোভ আর ক্ষমতার বশবর্তী হয়ে চরম অনিষ্টের অভিশাপ নামিয়ে আনতে দেখি।
এই গল্পে পাত্র-পাত্রীরা ভুল করেন, সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেন। সেখান থেকে নিজেকে আরও বেটার করেন। তারা ভালোবাসেন, ভালোবাসার জন্য নিজের সবচেয়ে দামী জিনিসটা ত্যাগ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। গল্পের বিভিন্ন চরিত্রকে আমরা গল্পের শুরুতে যেভাবে পাই, গল্পের শেষে গিয়ে লক্ষ করি সেই চরিত্রটা আর সেরকম নেই। নানান অভিজ্ঞতার মিশেলে সে হয়ে উঠেছে অন্য একজন, আরও পূর্ণ কেউ। এভাবেই ‘দি লর্ড অফ দ্য রিংস’র কল্পনার জগৎ আমাদের মনে বাস্তবের চেয়েও বেশি বাস্তব হিসেবে ধরা দেয়।
এই কাহিনীতে বন্ধুত্ব আছে সবচেয়ে নিঃস্বার্থ রূপে, প্রেম আছে সবচেয়ে মায়াবী চেহারা নিয়ে, বৃহত্তর ভালোর জন্য নিজেকে উজাড় করে দেয়াটা এখানে স¦মহিমায় উদ্ভাসিত। গল্পের মাঝে আমরা নিজেদের ক্ষুদ্রতাকে খুঁজে পাই। আবার গল্পের উন্নতি আর পরিণতি আমাদের সেই ক্ষুদ্রতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। বইয়ের মাঝে বারবার ফিরে আসে আমাদের অগণিত পরিচিত মুখ। আমরা দেখতে পার আত্মবিশ^াস কতটা উঁচুতে উঠলে জীবন বদলে দেয়, সংকল্প কতটা দৃঢ় হলে পর্বত পথ ছেড়ে দাঁড়ায়, আত্মত্যাগ কতটা মহান হলে মৃত্যুকেও মধুর লাগে।
মহিউল ইসলাম মিঠু
সাভার, ঢাকা
০৭ আগস্ট ২০২০
দি লর্ড অফ দ্য রিংস বুক ১ নিয়ে বিস্তারিত সব জানতে ক্লিক করুন: দি লর্ড অফ দ্য রিংস বই পরিচিতি