কথা ও সুরঃ শামস
ব্যান্ডঃ ওয়ারফেজ
এ্যালবামঃ সত্য
প্রকাশ: ২০১২
শুরু
যত সাজানো গল্পে,
রাঙ্গানো চাকচিক্যের আড়ালে
লুকানো সত্য নীরবে কেঁদেছে।
কিছু গান ভালোবেসে ফেলার জন্য বেশিবার শুনতে হয় না। একবারই যথেষ্ট। এরকম একটা গান হল ওয়ারফেজের ‘সত্য’। ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সত্য’ অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাক। শামস মনসুরের লেখা ও সুর করা গানটা মনের ভেতর কেমন একটা বিষণ্নতা এনে দেয়।
গানের শুরুতে কী-বোর্ডের ইন্ট্রোটা কী যে অসাধারণ! ভাই রে ভাই। অবশ্য শুধু কী-বোর্ড না, পুরো মিউজিক ডিজাইনই অসাধারণ। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক ছিল। ওয়ারফেজ বলে কথা, রোমেল আলী, শামসের মত কিবোর্ডিস্টরা এখানে বাজান।
গানের তিন মিনিটের মাথায় গিটার সোলোটা যেন গানের কথার সেই দ্রোহটারই প্রতিনিধিত্ব করে। সবমিলিয়ে পৃথিবীর অনুচিত নিয়মগুলোর প্রতি আমাদের যে গভীর আর অক্ষম ক্রোধ সেটাকে প্রচণ্ডভাবে অনুভব করা যায় গানটা শুনলে।
গানটা শুরু হল এভাবে:
যত সাজানো গল্পে,
রাঙ্গানো চাকচিক্যের আড়ালে
লুকানো সত্য নীরবে কেঁদেছে, নীরবে কেঁদেছে।
লোভনীয় বিকল্পে, ধাঁধানো মিথ্যার মায়াজালে
আমাদের চারপাশটা খুব সাজানো গোছানো। উন্নয়ন, প্রযুক্তি, আর শো-অফের চোখ ধাঁধানো চাকচিক্যে আমরা মোহিত। এসবকিছুর পেছনে যে অনেকগুলো কুৎসিত আর বিরাট বিরাট সত্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আমরা তা ভুলে যাচ্ছি। শুধু সত্যগুলো ভুলে যাচ্ছি না, সত্য গুলোকে যে ভুলে যাচ্ছি বা গেছি এই বাস্তবতাটাকেও ভুলে যাচ্ছি। সত্যগুলো মাথাচারা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু মিথ্যের মায়াজাল আর সহজ লোভনীয় বিকল্পগুলো নিয়ে আমরা এতই নিমগ্ন যে আমরা যেন ইচ্ছে করেই সত্যগুলোকে আর দেখতে চাই না। একটু ভালো করে দেখলেই যে সত্যগুলো দেখতে পাওয়ার কথা ভিত্তিহীন মায়াজালে মোহে পড়ে সেগুলোও দেখতে পাচ্ছি না। পাচ্ছি না নাকি চাচ্ছি না, সেটা অবশ্য একটা বিরাট প্রশ্ন। এই যে দেখতে না চাওয়া বা দেখতে না পাওয়ার ব্যর্থতা, যে বিষণ্ন ক্রন্দন আর নিষ্ফল আক্রোশ সেটা যেন ঠিকরে পড়ছে গানের প্রথম অংশে। আর আমাদের এই ব্যর্থতায় লুকানো সেই চিরন্তণ সত্যগুলো নীরবে কাঁদছে।
এরপর বলা হচ্ছে:
বেনিয়ার যে নকশায়
পৃথিবী রঙ বদলায়
বিপনন জীবন অবলীলায়…
কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কবলে পড়ে আমাদের এই পৃথিবী অনেকবার রঙ বদলেছে। এখনও বদলাচ্ছে, ভবিষ্যতেও বদলাবে। এই স্বার্থানেষী বেনিয়ারা আজকের আধুনিক পৃথিবীতে এমন এক সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করেছে যেখানে মানুষের জীবন যেন আর জীবন নেই বিপননের পণ্য হয়ে গেছে। উফ! কী ভয়ংকর বিদ্রোহী আক্ষেপ!
“গোপনীয় অবক্ষয়,
মানবেতর প্রাণের অনুনয়
বিকারী তথ্য সকল বাঁধ ভেঙ্গেছে
সাধারণের ধিক্কার,
সাদা মোড়কে লুন্ঠিত সুবিচার।”
শেষের এই কথাগুলো আগের আক্ষেপগুলোকে যেন নতুন মাত্রা দিচ্ছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। সেই লুকিয়ে কাঁদতে থাকা সত্যগুলোর দিকে ইঙিত করছে, যেগুলোকে আমরা জেনেও না জানার ভান করে থাকছি। সবমিলিয়ে শেষে এসে গানটা যেন আমাদের দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে নিজেদের বিবেকের সামনে।
আমার কাছে এই গানটা খুব শান্তভাবে প্রকাশিত একটা বিদ্রোহের গান। পৃথিবীর অনিয়ম অবিচার নিয়ে আমাদের সবার মধ্যেই একরকম ক্ষোভ, রাগ, আক্ষেপ, আর আক্রোশ আছে। গানটা শান্তভঙ্গিতে সেই নীরবে ফুসতে থাকা আগ্নেয়গিড়িতে একটা বড়সড় ঢেউ দেয়। শান্ত সুর যেন সুপ্ত সেই আগুনে অল্প অল্প ইন্ধন দেয়। আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্যের আগুনটাকে নিভতে দেয় না।
বি: দ্র: প্রতিটা গানের অর্থ, অনুভূতি, ভালোলাগা, ইত্যাদি জনে জনে একেকরকম হতে পারে। এখানে শুধু আমার অর্থ, অনুভূতি, ভালোলাগাই আলোচ্য।
বিদ্র১: লেখাটা আমি লিখেছিলাম Lyrics and Thoughts নামে একটা গ্রুপের জন্য। সেখানে গান এবং গানের অনুভূতিগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা করি আমরা। চাইলে ঘুরে আসতে পারেন।
বিদ্র২: আর “বিকারী তথ্য সকল বাধ ভেঙেছে”, এখানে বিকারী শব্দের অর্থ কী?
বিদ্র৩: ওয়ারফেজের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে গানটার ভিউ ২৫হাজারের মত। আর ‘তুমি আমার টুট টুট’ এই টাইপের অনেক গান মিলিয়ন ভিউ পায়।