নিহার নন্দিনী
জর্জ আর. আর. মার্টিনের “দি আইস ড্রাগন”। “সং অফ আইস অ্যান্ড ফায়ার” ইউনিভার্সের প্রথম বই। ছোট্ট ইলাস্ট্রেটেড বইটার কিছু অংশ এখানে দিয়ে দিচ্ছি। ইলাস্ট্রেশন সহ। বইয়ে যেমন আছে ঠিক তেমন। আশা করছি, এই একটা চ্যাপ্টার পড়ার পরে বইটা পড়তে চান কিনা এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়ে যাবে পাঠকদের জন্য।
মেয়েটার নাম অ্যাডারা। সে শীত ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে। শীত ভালোবাসে কারণ শীত আসলে চারপাশ যখন বরফে ঢেকে যায়, কনকনে হিমেল হাওয়া বয়, নীহার বিন্দু গাছের পাতায় ঝুলতে থাকে মুক্তোর মত, শুধুমাত্র তখন আইস ড্রাগন আসে।
অ্যাডারা জানে না, আইস ড্রাগন আসে বলেই শীত আসে নাকি শীত আসলেই আইস ড্রাগন আসে। এসব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাও নেই। শুধু সময়মত আইস ড্রাগন আসলেই সে খুশি। তবে এই সব প্রশ্ন নিয়ে যার প্রচন্ড মাথাব্যথা সে হল, অ্যাডারার ভাই গোয়েফ। গোয়েফ অ্যাডারার থেকে দুই বছরের বড়। তাবদ দুনিয়ার সবকিছু নিয়ে গোয়েফের ব্যাপক কৌতুহল, হাজার হাজার প্রশ্ন।
প্রচন্ড এক শীতের রাতে জন্মেছিল অ্যাডারা। এত তীব্রশীত আর কবে পড়েছিল মনে নেই কারো। এমনকি গ্রামের থুরথুরি বুড়ি লরা, যে এলাকার সবার জন্মের আগের কাহিনি জানে, সেও এমন তীব্র শীতের কোনো স্মৃতি মনে করতে পারে না। সেই তীব্র শীতের রাতের কথা এখনও পাংশু মুখে বলাবলি করে লোকজন। হিম-শীতল অভিব্যক্তি নিয়েই সব শোনে হিমকন্যা অ্যাডারা, নিজে কিছু বলে না, কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখায় না।
অ্যাডারাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান অ্যাডারার মা। লোকজন সেই কাহিনীও বলাবলি করে নিজেদের মধ্যে। যদিও সরাসরি অ্যাডারাকে কেউ কিছুই বলে না, কিন্তু অ্যাডারা সবই শুনতে পায়, সবই জানে। কেউ কেউ তো এমনও বলে যে, শীত অ্যাডারার মায়ের জরায়ুতে ঢুকে গিয়েছিল, এই জন্যই অ্যাডারার রং এমন ফ্যাকাশে, শরীর এমন শীতল। আড়ালে আবডালে কেউ কেউ তাকে হিমকন্যা (উইন্টার’স চাইল্ড) ডাকে।
অ্যাডারা চুপচাপ শুনে যায়। নিরুত্তাপ, নিরুদ্বেগ, প্রতিক্রিয়াহীন। বলার কিছু নেইও অবশ্য। লোকের কথা অবিশ^াস করারও উপায় নেই। সত্যিই তার গায়ের রং কেমন ফ্যাকাশে, নীলাভ একটা আভা আছে। আর আডার শরীরও সবসময় ঠান্ডা থাকে, কখনও গরম হয় না। সবাই বলে শীত তাকে চুমু দিয়ে গেছে, নিজের করে গেছে। তবে যে যাই বলুক, বাবার কাছে সে তুষার তনয়া, নীহার নন্দিনী।
মোটকথা, প্রায় সবাই অ্যাডারাকে একটু অন্য চোখে দেখে, স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। আবার এটাও সত্যি যে, অ্যাডারা তার বয়সী আর দশটা মেয়ের মতও না। চুপচাপ ধরনের, কারো সাথে খেলা-ধূলা, ছুটাছুটি, এসবে তেমন আগ্রহ নেই। সবাই তাকে সুন্দর বলে, অনেকবার শুনেছে সে। কিন্তু ও জানে না, ওর ফ্যাকাশে রংটা হলদেটে সোনালী চুলের সাথে মানিয়ে গেছে ভীষণভাবে। আর সাথে স্বচ্ছ উজ্জ্বল নীল চোখ ওর পার্থিব সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সবমিলিয়ে ওর প্রতি কৌতুহল জাগবেই যে কারো, কাছে আসতে মন চাইবে, জানতে ইচ্ছে করবে, কিন্তু বড় ছোট সবাই তার থেকে একটু যেন দূরে দূরে থাকতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে।
এই মেয়ে হাসে খুব কম। আর তাকে কখনও কাঁদতে দেখেনি কেউ। তার বয়সী মেয়েরা যেমন কিছু হতে না হতেই ভ্যা করে কেঁদে দেয়, অ্যাডারার মধ্যো এমন কোনো বাতিক নেই। একবার পায়ে পেরেক ঢুকেছিল ওর। বরফের নিচে একটা ছোট কাঠের তক্তায় লাগানো প্যারেক, তাই দেখতে পায়নি। পা দিতেই একবারে আমূল গেথে গিয়েছিল গোড়ালিতে। পেরেক একদম গোড়ালির হাড়ে গিয়ে ঠেকল। অ্যাডারা মুখে রা শব্দটি করল না। চুপচাপ বসে দাঁত চেপে টেনে বের করল পেরেক। তারপর বরফে রক্তের ছাপ ফেলতে ফেলতে বাড়ি গিয়ে বাবাকে আস্তে করে বলল, “বাবা, ব্যথা পেয়েছি।”
অ্যাডারার পরিবারও জানত যে সে আর সবার চেয়ে একটু আলাদা। তার বাবা এক বিশালদেহী মানুষ। সারাদেহে ঘন লোম। ভাল্লুকের মতই শক্তি শরীরে। সবসময় নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। অন্যান্যদের সাথে ওঠাবসা একটু কমই। কিন্তু মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগেই থাকে। কাজের মাঝে গোয়েফ যখন হাজারটা প্রশ্ন করে, হাসিমুখে সবপ্রশ্নের উত্তর দেয়। টেরিকে দেখলেই কোনো একটা কমপ্লিমেন্ট দিয়ে হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে। অ্যাডারার বড়বোন টেরি, পাড়ার সব ছেলের সাথে তার ঈষৎ ভাব লক্ষ্য করা যায়। আজ একে দেখে হাসে, কাল আরেকজনের সাথে হাটতে বের হয়।
আডারাকেও প্রায়ই জড়িয়ে ধরে বাবা। কিন্তু তখন আর তার মুখে সেই হাসিটা থাকে না। শুধু খুব শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে। গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে। কখনও কখনও খুব বড় এক ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। কিন্তু বাবার এতসব আবেগ-ভালোবাসা শুধু শীতের সময়ই দেখা যায়। গ্রীষ্মের সময় বাবার সাথে ঠিকমত কথা বলার সময় পাওয়াও কঠিন। গরমের সময় সারাদিন ব্যস্ত থাকেন বাবা।
অবশ্য গ্রীষ্ম আসলে শুধু বাবাই না, সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সবাই, শুধু অ্যাডারা বাদে। গোয়েফ বাবার সাথে মাঠে কাজ করে। এটা সেটা নিয়ে হাজার হাজার প্রশ্ন করে। যখন বাবার সাথে কাজ থাকে না, তখন বন্ধুদের সাথে খেলে বেড়ায়, নদীর ধারে ছোটাছুটি করে। জঙ্গলে পাখির বাসা দেখে বেড়ায়। টেরি বাড়ির কাজ-কর্ম করে, সবার জন্য রান্না-বান্না করে। মাঝে মাঝে পাশের একটি সরাইখানায় কাজও করে। সরাইখানার মালিকের মেয়ে তার বান্ধবী আর ছোট ছেলে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু। সরাইখানায় কাজের শেষে ছেলেটা তাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। তখন টেরিকে খুব খলখল করতে দেখা যায়। সরাইখানা থেকে ফিরে রাজ্যের সব খবর নিয়ে আসে টেরি। সরাইখানায় বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্নরকম লোক আসে, তাদের কাছ থেকে নানারকম খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে রাজার সৈনিকরা আর রাজধানীর বণিকরা আসলে খবর বেশি আসে।
সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে বাবা। প্রতিদিন হাজার হাজার কাজ করে। আরো হাজার হাজার কাজ বের করে। সারাদিন ক্ষেতে কাজ করে। ফিরে এসে বাড়ির এটা সেটা পুরুষালি কাজ করে। শুধু মাত্র গরম আসলেই বাবার গা থেকে ঘামের গন্ধ পাওয়া যায়। তার পেশী থেকে মেদের শেষ অংশটুকু বিদায় নেয়। রাতে বাবা গোয়েফকে নানান গল্প শোনায়, তার শত শত প্রশ্নের জবাব দেয়। আবার টেরিকে রান্নাঘরের বিভিন্ন কাজ নতুন করে দেখিয়ে দেয়, এটা সেটা কাটাকাটি করে মেয়েকে সাহায্য করে। মাঝে মাঝে সরাইখানাতেও যায়। তবে গরমের সময় তেমন একটা মদ খাওয়ার দরকার পড়ে না তার। গরমের সময় বাবাকে মদ খেতে দেখা যায় শুধু তার ছোট ভাই আসলে।
এই আরেকটা কারন যেজন্য গোয়েফ আর টেরি গ্রীষ্ম পছন্দ করে। আংকেল হাল। বাবার ছোট ভাই। গ্রীষ্মে, গাছগুলো যখন সবুজ পাতায় ভরে ওঠে, চারদিক প্রাণের উচ্ছ¡লতা বেড়ে যায়। হাল আংকেল শুধু তখন আসে।
হাল আংকেল একজন ড্রাগন-রাইডার। রাজার ড্রাগন বাহিনিতে কাজ করে। লম্বা, সুদর্শন মানুষটাকে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। চেহারায় একটা সম্ভ্রান্তভাব। মাথায় অল্প কয়েকটা পাকা চুল সেই সম্ভ্রান্তভাবটা আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
ড্রাগনরা শীত সহ্য করতে পারে না। তাই শীত আসলেই ড্রাগনের বাহিনি নিয়ে দক্ষিণের দিকে চলে যায় আংকেল হাল। আবার গ্রীষ্মে ফিরে আসে। রাজকীয় সেনাবাহিনীর চকচকে সবুজ আর সোনালী পোশাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
প্রতিবার এসে নানার সব যুদ্ধের গল্প করে আংকেল হাল। এত যুদ্ধেও কাহিনি শুনে শুনে অ্যাডারার মনে হত, সারাবছর শুধু যুদ্ধই চলে সবদিকে। আর আংকেল হাল শুধু যুদ্ধই করে।
প্রতিবারই আংকেল হাল নানারকম উপহার নিয়ে আসতেন। শহর থেকে নানান রকম খেলনা, ঝলমলে পাথরের সুন্দর সুন্দর সব অলংকার, সুস্বাদু ক্যান্ডি, বড় ভাইয়ের জন্য দামি মদ।
টেরিকে বিভিন্নরকম সুন্দর সুন্দর কথা বলে আর অলংকার দিয়ে খুশি করতেন। গোয়েফকে শোনাতেন রাজ্যের সব যুদ্ধ, ড্রাগন আর প্রাসাদের গল্প। অ্যাডারার মনও জয় করার চেষ্টা করতেন নানানভাবে, কিন্তু সফলতা কমই আসত। আংকেল হালের ছেলেমানুষিগুলো অ্যাডারার খুব যে খারাপ লাগত তা নয়। কিন্তু প্রকাশ করাটা কেমন যেন কঠিন ছিল।
এতকিছু ভালো লাগার পরেও আংকেল হাল আসলে অ্যাডারা খুশি হতে পারত না। কারন আংকেল হাল এসেছেন মানে, শীত আসতে এখনও অনেক দেরি। শীত আসতে দেরি মানে আইস ড্রাগন আসতেও অনেক দেরি।
অ্যাডারার বয়স যখন চার, তখনকার একটা ঘটনা বেশ ভালোভাবে মনে আছে অ্যাডারার। আংকেল হাল আর বাবার কাছাকাছিই ঘুমিয়েছিল সে। আংকেল হাল বাবাকে বলছিলেন, “অ্যাডারার দিকে আরেকটু বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত তোমার, জন! যা ঘটে গেছে তার জন্য ওকে দায়ী করে কি লাভ?”
“দায়ী করি কে বলল? ও দেখতে ওর মায়ের মতই হয়েছে। ওকে দেখলেই আমার ওর মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। ও দেখতে বেথের মত হলেও বেথের সেই উষ্ণতা ওর মধ্যে নেই। ওর মধ্যে একধরনের শীতলতা দেখতে পাই আমি।” উত্তর দিলেন বাবা।
“এমনও তো হতে পারে, ওকে জন্ম দিতে গিয়ে বেথ মারা গেছে বলে ওকে হয়তো ভেতরে ভেতরে একটু হলেও দায়ী মনে হয়। এজন্যই হয়তো এমন মনে হয় তোমার! হয়তো অ্যাডারাকে টেরি আর গোয়েফের মত ভালোবাসো না তুমি!”
“না রে ভাই। ব্যাপারটা সেরকম না।” অদ্ভূত একটা হাসি দিয়ে বললেন বাবা. “ব্যাপারটা কিরকম তা আমিও ঠিকমত বুঝি না। কিন্তু এটা জানি, ওকেই সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসি আমি। ও আমার ছোট্ট শীতের পাখি! আমার হিমকন্যা! আমার নীহার নন্দিনী! কিন্তু আমার সেই ভালোবাসা ওকে ছুতে পারে না। আমাদের জন্যও ওর মধ্যে খুব বেশি ভালোবাসা আছে বলে মনে হয় না আমার। ওর ভেতরটাও ওর শরীরের মতই শীতল, চোখের মত শান্ত নীল। ও শুধু দেখতেই ওর মায়ের মত।” হাসিটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে অ্যাডারার।
চার বছর বয়সে যখন কথাগুলো শুনেছিল তখন ও বোঝেনি। আর ছয় বছর বয়সে যখন বুঝেছিল, তখনও কান্না পায়নি।
কিছুদিন পর আংকেল হাল তার ড্রাগন বাহিনি নিয়ে রাজধানীর দিকে রওনা হল। আংকেলের ড্রাগনের পিছে পিছে আরো গোটা ত্রিশেক ড্রাগন আকাশে উড়ল। দেখার মত এক দৃশ্য। টেরি আর গোয়েফ সজোড়ে হাত নাড়াতে থাকল যতক্ষণ না, আকাশে ড্রাগনদের চিহ্ন মিলিয়ে গেল। কেবল অ্যাডারা ড্রাগনদের মিলিয়ে যাওয়া দিগন্তে তাকিয়ে থাকল নির্লিপ্ত নীল চোখে।
প্রথম অধ্যায় শেষ
প্রতিটি অধ্যায়েই এরকম ৪-৫ করে ইলাস্ট্রেশন রয়েছে। লুইস রয়ো’র আঁকা ছবিগুলো পড়ার আনন্দ বহুগুন বাড়িয়ে দেবে।
বইটির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সবকিছু জানতে ক্লিক করুন- দি আইস ড্রাগন