১
অপ্রত্যাশিত উৎসব
এক গর্তে বাস করত এক হবিট। গর্ত শুনলে যেমন স্যাঁতস্যাঁতে, নোংরা একটা জিনিসের কথা মনে পড়ে। এই গর্ত মোটেও সেরকম নয়। গর্তটা একটা হবিটের। হবিটের গর্ত মানে সুন্দর সাজানো, গোছানো, পরিপাটি একটা গর্ত। হবিটের বাড়ি। এক কথায় যাকে সুখের স্বর্গ বলে।
হবিটরা বাস করে পাহাড়ের পাদদেশে। পাহাড় খুঁদে তৈরি হয় বাড়ি। সেদিক থেকে হবিটদের বাড়িগুলোকে গর্ত বললে ভুল হয় না মোটেই। বরং কেউ কেউ সেগুলোকে ‘হবিট-হোল’, সোজা বাংলায় ‘হবিটের গর্ত’ বলতেই বেশি স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করে।
যাই হোক যে বাড়িটার কথা চলছিল সেটার দরজাটা একেবারে পার্ফেক্ট বৃত্ত আকৃতির। পুরোপুরি গোল দরজার ঠিক মাঝে হলুদ রঙের নব্। আর দরজাটা সবুজ। দরজা খুললেই লম্বা প্যাসেজ দেখা যায়। প্যানেল করা কার্পেট বিছানো ছিমছাম লম্বা প্যাসেজ। বাড়ির সব ঘর, রান্নাঘর থেকে শুরু করে শোবার ঘর পর্যন্ত সব, এই প্যাসেজের দুপাশে। সব হবিটদের বাড়িই এরকম হয়। আমাদের এই বাড়িটা যে পাহাড়ের পাদদেশে সেই পাহাড়টাকে স্থানীয় লোকজন ‘দি হিল’ বলে চেনে। এই বাড়িতে জানালা শুধুমাত্র একটা। জানালাটা যে ঘরে সেটা, ঢোকার সময়, প্যাসেজের বাম পাশে। জানালাটাও গোল। সেই গোল জানালা দিয়ে বাড়ির সামনের বাগান থেকে শুরু করে নদী পর্যন্ত সব দেখা যায়।
এই সুন্দর বাড়িটা যে হবিটের, তার নাম ব্যাগিন্স। এই ব্যাগিন্সরা এই এলাকায় কতদিন যাবৎ আছে তা কেউ জানে না। ব্যাগিন্স পরিবারের যে পূর্বপুরুষ প্রথম এই এলাকায় এসে আস্তানা গেড়েছিল সে গত হয়েছে অনেক অনেক বছর আগে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা এই এলাকায় আছে। সেই হিসেবে ব্যাগিন্সরা এলাকার স্থানীয় হবিট। এলাকার অন্যান্য হবিটরা ব্যাগিন্সদের যথেষ্ট সম্মান করে। অর্থনৈতিকভাবেও ব্যাগিন্স পরিবার বেশ স্বচ্ছল। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাও তাদের সম্মান অর্জনে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে।
ব্যাগিন্সরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঝামেলাহীন, শান্তিপূর্ণ জীবন কাটিয়ে আসছে। সুখে-শান্তিতে, নির্ঝঞ্ঝাট কাটে তাদের জীবন। ব্যাগিন্স পরিবারের কেউ কখনও কোন অ্যাডভেঞ্চারে গিয়েছে এমন কথা কেউ শোনেও নি কোনদিন। সবার ধারণা নিরুদ্রপ জীবন কাটাতেই ভালোবাসে ব্যাগিন্সরা। সবার ধারণা যে ভুল তাও নয়। কিন্তু আমাদের এই গল্প, সেই ব্যাগিন্স পরিবারের একজনের এক অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চার গল্প।
অনেকের মধ্যে নিশ্চয়ই অলরেডি একটা প্রশ্ন চলে এসেছে, ‘হবিট আবার কি?’ আজকাল হবিটদের সম্পর্কে মানুষ কমই জানে। এজন্য হবিটদের সাথে অল্প-বিস্তর পরিচয় করিয়ে দেয়াটা দরকারি বলেই মনে করছি।
হবিটরা সাইজে আমাদের, মানে মানুষের, অর্ধেক। একজন পূর্ণবয়স্ক হবিটের উচ্চতা আমাদের কোমড় পর্যন্ত। সেদিক থেকে দেখলে বামনরাও এদের চেয়ে লম্বা হয়। হবিটরা আমাদের বলে ‘বড় মানুষ’। আর এই ‘বড় মানুষ’ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতেই ভালোবাসে এরা। আশেপাশে কোন মানুষের আভাস পেলেই হাতির ডাকের মত আওয়াজ করে একে অপরকে জানিয়ে দেয় হবিটরা। এই শব্দ নাকি মাইলখানেক দূর থেকেও শুনতে পায় এরা। আর এই শব্দ পাওয়া মাত্রই নিজেদের লুকিয়ে ফেলে সবাই। এই আড়ালে থাকা স্বভাবের জন্যই এদের অস্তিত্বের কথা শোনা যায় বটে কিন্তু অনেকেই মনে করে হবিটরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে আমার বিশ্বাস পৃথিবীর কোথাও না কোথাও এখনও আত্মগোপন করে আছে এই হবিটরা।
যাইহোক, হবিটদের দাঁড়ি-গোঁফ থাকে না। সাধারণত উজ্জ্বল রঙের পোশাক পড়তে ভালোবাসে এরা। সবুজ আর হলুদ হবিটদের পছন্দের রঙ। পায়ে জুতো পড়ে না। এদের পায়ের পাতার চামড়া এমনিতেই বেশ খানিকটা মোটা হয় আর পায়ের তলায় সোনালী রঙের পশম থাকে। ফলে আলাদা করে জুতো-টুতোর দরকার হয় না এদের। হবিটদের চুলের রঙ সাধারণত সোনালী হয়। আপাতত হবিটদের ব্যাপারে এতটুক্ু জানলেই চলবে। এবার আগের কথায় ফিরে আসি।
আমাদের আলোচিত হবিটের নাম বিলবো ব্যাগিন্স। বিলবোর মায়ের নাম বেলাডোনা টুক্্। টুক্ পরিবারের মেয়ে। ব্যাগিন্স পরিবারের কেউ কখনও অ্যাডভেঞ্চারে যায় নি কিন্তু টুক্ পরিবারের একজন গিয়েছিল। এদিক থেকেই হয়ত বিলবোর মধ্যে অ্যাডভেঞ্চারের বীজ চলে এসেছিল। সুন্দরী বেলাডোনা টুকের বিয়ে হল মি. ব্যাঙ্গো ব্যাগিন্সের সাথে। বেলাডোনা টুক্ বনে গেলেন মিসেস ব্যাঙ্গো ব্যাগিন্স। ব্যাঙ্গো খুব আরামপ্রিয় মানুষ ছিলেন। স্ত্রীর জন্য তৈরী করলেন হবিট পল্লীর সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি। এত সুন্দর বাড়ি ওই এলাকায় আর কারও ছিল না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ব্যাঙ্গো ব্যাগিন্স দম্পতি ঐ বাড়িতেই ছিলেন। বিলবোও তার বাবার মতই আরামপ্রিয় হবিট। বাবার তৈরী সুন্দর বাড়িতে আরামেই কাটছিল তার জীবন।
টুক্ পরিবার থেকে তার মধ্যে অ্যাডভেঞ্চারের যে বীজ চলে এসেছে ব্যাগিন্স পরিবারের আরামপ্রিয় স্বভাবের কারণে সেই বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। অবশেষে সেই বীজ যখন অঙ্কুরিত হওয়ার সুযোগ পেল তখন বিলবোর বয়স পঞ্চাশ। কি, খুব বেশী মনে হচ্ছে? একজন হবিটের জন্য পঞ্চাশ বছর বয়সকে ‘যুবক বয়স’ বললেই ঠিক বলা হয়। অনেক দীর্ঘায়ু হয় হবিটরা। সাধারণত ১০০ বছরের বেশি বাঁচে।
যাইহোক যে কথা বলছিলাম, অবশেষে একদিন বিলবোর সেই অ্যাডভেঞ্চারের বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার সুযোগ পেল।
অনেক অনেকদিন আগের এক সুন্দর সকাল। পৃথিবী তখন এত কোলাহলপূর্ণ ছিল না, চারপাশটা তখন অনেক নিরিবিলি। আর চারদিকে ছিল সবুজের সমারোহ। সবচেয়ে বড় কথা তখন হবিটদের সংখ্যা আর প্রাচুর্য দুটোই অনেক বেশী ছিল। যাইহোক, অনেক অনেক দিন আগের সেই সকালে বিলবো ব্যাগিন্স সকালের নাস্তা সেরে বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার বিরাট সাইজের কাঠের পাইপ নিয়ে আয়েশ করে ধূমপান করছিল। এমন সময় সেখানে উদয় ঘটল গ্যান্ডাল্ফের। বিখ্যাত গ্যান্ডাল্ফ্! আমি তার সম্পর্কে যা জানি, কেউ যদি তার চার ভাগের একভাগও জানে তাহলে এতক্ষণে সে নিশ্চয়ই বুঝে গেছে কি পরিমাণ মারাত্মক অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী হতে পারে এটা। তবে এখানে ছোট্ট করে বলে রাখা ভালো, আমি যা জানি সেটাও গ্যান্ডাল্ফের আসল কর্মকান্ডের অতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তারমানে গ্যান্ডাল্ফের জীবন আসলে কতটা অ্যাডভেঞ্চার আর রোমাঞ্চে ভরা সেটা সহজেই অনুমেয়।
ঐ এলাকায় অনেকদিন ধরে দেখা যায় নি গ্যান্ডাল্ফ্কে। বুড়ো টুকের সাথে ভালো খাতির ছিল গ্যান্ডাল্ফের। বুড়ো টুক্ মারা যাওয়ার পর, দি হিলের আশেপাশে অনেক অনেক বছর ধরে কেউ দেখেনি গ্যান্ডাল্ফ্কে। নিরীহ হবিটরা তো রীতিমত তার চেহারাটা ভুলতেই বসেছিল। স্বাভাবিকভাবেই গ্যান্ডাল্ফ্কে চিনত না বিলবো। কারন এই এলাকায় যখন গ্যান্ডাল্ফের আনাগোনা বেশি ছিল তখন বিলবোর জন্মই হয়নি। সে শুধু দেখলো লাঠি হাতে একটা বুড়ো লোক তাকিয়ে আছে তার দিকে। লোকটার মাথায় লম্বা একটা নীল টুপি, গায়ে ধূসর রঙের একটা আলখেল্লা, লম্বা দাঁড়ি প্রায় কোমড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। আর পায়ে মিশমিশে কালো বুট। লোকটাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিলবো ঐ ভাবল কিছু একটা বলা উচিত। কিন্তু কথা খুঁজে না পেয়ে ছোট্ট করে বলল, “শুভ সকাল!” কথাটা মন থেকেই বলেছিল বিলবো। কারণ সকালটা সত্যিই সুন্দর ছিল। আকাশে ঝলমলে রোদ, সুন্দর সবুজ ঘাসে সকালের মিষ্টি রোদকে লুটোপুটি খেলতে দেখে সত্যিই মন ভালো হয়ে গিয়েছিল আয়েশী বিলবোর।
এদিকে গ্যান্ডাল্ফ্ তার ঝোঁপের মত চোখের ভ্র’র ফাঁক দিয়ে তীক্ষè চোখে কিছুক্ষণ বিলবোর দিকে তাঁকিয়ে থেকে বলল, “মানে কি? কি বোঝাতে চাইছ তুমি? তুমি কি আমার জন্য সুন্দর সকাল কামনা করছ, নাকি বলতে চাইছ যে আমি চাই বা না চাই আজকের সকালটা সুন্দর, নাকি বোঝাতে চাচ্ছ যে আজকের এই সকালে তোমার মনটা ভালো, নাকি বলতে চাইছ যে এটা ভালো থাকার মত একটা সকাল?”
“সবগুলো একসাথে।” অদ্ভূত প্রশ্ন শুনে ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর দিল বিলবো। তারপর যোগ করল, “আর পাইপ টানার জন্যও আজকের সকালটা ভালো। যদি চান তাহলে আমার সাথে বসে একটু পাইপ টানতে পারেন।” তারপর দরজার সামনে একটা চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে মুখ দিয়ে গোল করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। ধোঁয়া পুরো বৃত্তের মত হয়ে উপরে উঠতে লাগল। সত্যিই দেখার মত ছিল বিলবোর ধোঁয়ার বৃত্তটা।
বৃত্তটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গ্যান্ডাল্ফ্ বলল, “খুব ভালো। কিন্তু বসে বসে ধোঁয়ার রিং বানানোর মত সময় নেই আমার। আমি একটা অ্যাডভেঞ্চারের আয়োজন করছি। আর সেই অ্যাডভেঞ্চারের জন্য একজন সদস্য খুঁজছি।”
“আরে! এদিকে সেরকম কাউকে পাবেন না। এদিক্কার সবাই শান্তিপ্রিয়। অ্যাডভ্যাঞ্চারের মত বাজে কাজে এদের কোন আগ্রহ নেই। এইসব অ্যাডভেঞ্চার-ট্যাডভেঞ্চারে যে লোকে কেন যায় কে জানে!” কথাটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা ধোঁয়ার রিং আকাশের ঠিকানায় পাঠিয়ে লেটারবক্সের দিকে এগিয়ে গেল বিলবো। তারপর লেটার বক্স থেকে খুব যতেœ চিঠিগুলো বের করে এমন মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করল যেন বুড়ো লোকটা যে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে তা খেয়ালই নেই। কিন্তু বুড়োটা যেন তাতে আরও বেশি মজা পেল। হাতের লম্বা লাঠিটাতে ভর দিয়ে তাঁকিয়ে থাকল বিলবোর দিকে, যেন খুব মজা পাচ্ছে। যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখাচ্ছে না বুড়ো। এদিকে বিলবো বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে যে লোকটা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকিয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তি অনুভব করতে লাগল সে। শেষপর্যন্ত উট্কো লোকটাকে বিদায় করার জন্য বলতে বাধ্য হল, “এই এলাকায় আমরা কেউ কোনরকম অ্যাডভেঞ্চারে আগ্রহী নই, আপনি বরং নদীর ওপারে একবার খোঁজ করে দেখুন। ঠিকাছে, শুভ সকাল!” সাধারণত এভাবে কথা বলে না বিলবো, এটা তার স্বভাবের মধ্যেই নেই কিন্তু এবার নিতান্ত বাধ্য হয়ে বলতে হল ওকে।
এবার শুভ সকাল কথাটা বিদায় সম্ভাষণ হিসেবে বলেছিল বিলবো কিন্তু বুড়ো লোকটা এবারও ‘শুভ সকাল’ কথাটার অন্য মানে খুঁজে পেল। বলল, “আচ্ছা, শুভ সকাল কথাটা কত কারণে ব্যবহার কর তুমি? এবার তো এমনভাবেই বললে যেন আমি বিদায় না হলে তোমার সকালটা কোনভাবেই শুভ হয়ে উঠতে পারছে না!”
“না না না, সেরকম কিছু নয়। আসলে, আপনাকে চিনি বলে মনে হচ্ছে না…… তাই ……” মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করল বিলবো।
“মি. বিলবো ব্যাগিন্স, তুমি বেশ ভালোভাবেই চেনো আমাকে। অন্তত আমার নাম তো অবশ্যই শুনেছ। তুমি শুধু জানো না যে, সেই নামটার মালিক আমি। আরে, আমি গ্যান্ডাল্ফ্, বুঝলে টুকের নাতি?”
“গ্যান্ডাল্ফ্! হায় খোদা! আপনিই গ্যান্ডাল্ফ্!” একটু উত্তেজিত শোনালো বিলবোর গলা, “আপনিই সেই লোক যে বিভিন্ন পার্টিতে এসে নানা রকম মজার মজার গল্প বলতেন? ড্রাগন, গব্লিন, দৈত্য-দানব, এসবের গল্প! খুব ভালো আতশবাজি করতেন! ওল্ড টুক্ (বিলবোর নানা, বেলাডোনার বাবা) মাঝেমাঝেই আপনাকে আনতেন আতশবাজি দেখানোর জন্য। বিশেষ করে ‘মিড্সামার ইভ’-এর পার্টির সময়। সত্যিই খুব অসাধারণ ছিল আতশবাজিগুলো, কি সুন্দর বিভিন্ন রকম ফুল আকাশে উড়ে যেত, দেখে মনে হত যেন আগুনের ফুল ফুটেছে আকাশে!” কথা যেন শেষই হচ্ছে না বিলবোর, “আপনার গল্প শুনেই তো এই এলাকার শান্ত-শিষ্ট ছেলে-মেয়েরা অ্যাডভেঞ্চারের জন্য বেরিয়ে পড়ত! এল্ফদের খুঁজতে যাওয়া, জাহাজে করে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো, কত কিছুই না করত বোকা ছেলে-মেয়েগুলো! যাইহোক, আপনি কি এখনও আতশবাজির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন? আসলে, আমি ঠিক জানি না তো, তাই জিজ্ঞাসা করছি আর কি! আর আপনাকে চিনতে পারিনি বলে কিছু মনে করবেন না, প্লিজ।”
“অন্তত আমার আতশবাজির কথা তোমার মনে আছে জেনে খুশি হলাম। আর, যা চেয়েছ তা অবশ্যই পাবে, বুড়ো টুক্ আর বেচারী বেলাডোনার খাতিরে হলেও দেব সেটা তোমাকে দেব আমি।”
“কিছু মনে করবেন না, সম্ভবত কোথাও ভুল হচ্ছে আপনার। আপনার কাছে কিছুই চাই নি আমি।”
“চাও নি মানে! এখনই তো আবার চাইলে, মোট দুবার হল। এ নিয়ে মোট দুবার তুমি আমাকে কিছু মনে না করার অনুরোধ করেছ। আচ্ছা যাও, মাফ করলাম, কিছু মনে করলাম না। আর তোমাকে আমার এই অ্যাডভেঞ্চারেও নিয়ে নিলাম। আমার জন্য ভালো, তোমার জন্যও ভালো। আর ঠিকভাবে ফিরতে পারলে অনেক লাভও হবে তোমার।”
“না না না! কোন অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার।” এই বলে ঘরের দিকে এগোতে লাগল। ভেতরে ঢুকে দরজা লাগানোর আগে বলল, “আজ তাহলে আসুন! একদিন সময় করে চা খেতে আসবেন কিন্তু! কালই চলে আসুন না! চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে। আজ তাহলে …… বিদায়!” কথাটা শেষ করেই গোল সবুজ দরজাটা চাপিয়ে হুড়কো তুলে দিল। গ্যান্ডাল্ফ্কে ভদ্রভাবে তাড়ানোর এর চেয়ে ভালো কোন বুদ্ধি আসছিল না তখন। আবার জাদুকর মানুষ, খারাপ ব্যবহার করলে কি না কি করে বসে কে জানে। মুখে বললেও বিলবো মোটেও চাচ্ছিল না যে গ্যান্ডাল্ফ্ আবার আসুক। এই আপদ যতবার আসবে ততই বিপদ। অন্তত ঐমূহুর্তে সেরকমই মনে হচ্ছিল বিলবোর।
রান্নাঘরের দিকে এগোতে এগোতে বিলবো আপন মনে বলে উঠল, “কি দরকার ছিল উটকো লোকটাকে চা খেতে আসতে বলার?” যদিও খানিক্ষণ আগে নাস্তা সেরেছে তবে এই মূহুর্তে একটা-দুটো কেক আর এক কাপ চা হলে খারাপ হয় না, এই চিন্তা করত করতেই রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল ও।
বিলবো যখন রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছে ঠিক তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে হাসছিল গ্যান্ডাল্ফ্। এরপর হাতের লাঠিটার সূঁচালো আগাটা দিয়ে বিলবোর সবুজ সদর দরজার উপর একটা অদ্ভুত চিহ্ন এঁকে দিয়ে চলে গেল। আর বিলবো ততক্ষণে তার দ্বিতীয় কেকটা গলধঃকরণ করতে করতে ভাবছিল, উটকো ঝামেলাটা ভালোভাবেই বিদায় করতে পেরেছে। ভেবে বেশ স্বস্তিও পাচ্ছিল।
পরদিন বিলবো মোটামুটি ভুলেই গিয়েছিল পুরো ঘটনা। হয়তো বা গ্যান্ডাল্ফ্কেও তার মনে থাকত না যদি না অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডায়েরীতে লিখে রাখত – ‘গ্যান্ডাল্ফের সাথে চা, বুধবার’।
টি-টাইমের একটু আগে সদর দরজার ঘন্টাটা জোরে-সোরে বেজে উঠল। ঠিক ঐমুহুর্তে বিলবোর মনে পড়ল যে গ্যান্ডাল্ফ্কে চায়ের দাওয়াত দিয়েছে সে। তড়িঘড়ি করে চায়ের কেটলিটা চুলোয় চাপিয়ে, অতিরিক্ত একটা কাপ আর কয়েকটা কেক বের করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে।
“বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত!” দরজা খুলে এই কথাটা বলতে শুরু করতে করতেও থেমে গেল বিলবো। দরজার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে গ্যান্ডাল্ফ্ নয়, একটা বামন। বামনটার চোখ দু’টো উজ্জ্বল চকচকে, গাঢ় সবুজ একটা আলখেল্লা গায়ে আর দাঁড়িগুলো নীল্চে ধরনের। বিলবো দরজা খোলা মাত্র বামনটা ভাব নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল যেন তাকে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়েছে।
গাঢ় সবুজ আলখেল্লাটা ঝুলিয়ে রেখেই বিলবোর দিকে তাকিয়ে বাউ করে বলল, “ডোয়ালিন, আপনার সেবায় হাজির!” ঘটনার আকস্মিকতায় আমাদের হবিট রীতিমত থতমত খেয়ে গিয়েছে। এর আগে কেউ তাকে এভাবে সম্বোধন করেনি, তাই কিভাবে উত্তর দেয়া উচিত ভেবে পাচ্ছিল না। একইভাবে সম্বোধনের উত্তর দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হল তার। কোনরকম সাম্লে নিয়ে সম্পূর্ণ একইভাবে বাউ করার চেষ্টা করে সে বলল, “বিলবো ব্যাগিন্স, আপনার সেবায়!” এরপর দু’জনের কেউই যেন আর কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাটা কিছুটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠলে ভদ্রতাবশত বিলবো বলল, “আমি চায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, আসুন একসাথে একটু চা খাই।” প্রথমে বিলবো কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল সত্যিই কিন্তু চায়ের কথাটা পুরো আন্তরিকভাবেই বলল সে। অতিথিপরায়ণতার জন্য এ তল্লাটে তার ভালো সুনাম আছে।
দুজন টেবিলে বসল। খুব বেশিক্ষণ হয়নি, কেবল তিন নম্বর কেকটা খেতে শুরু করতে যাবে এমন সময় আবার বেজে উঠল সদর দরজার ঘন্টাটা। “এক্সকিউজ মি!” এই বলে আবার দরজার দিকে এগিয়ে গেল বিলবো। এবার গ্যান্ডাল্ফ্ এসেছে এই ভেবেই দরজার সিটকানি খুলল বিলবো। এরপর “শেষ পর্যন্ত এলেন তাহলে!” বলতে বলতেও থেমে যেতে হল বিলবোকে। এবারও গ্যান্ডাল্ফ নয়, অন্য কেউ। সাদা দাঁড়িওয়ালা বুড়োর মতন দেখতে আরেকটা বামনকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্বিতীয়বারের মত অবাক হল বিলবো। কিন্তু তার অবাক হওয়া তখনও অনেক বাকি। এবারের বামনও আগেরজনের মত মেহমান স্টাইলে তার লালচে আলখেল্লাটা রেখে, ঠিক আগের বামনের স্টাইলে বাউ করে বলল, “বালিন, আপনার সেবায়!”
“ধন্যবাদ।” বলতে বলতে বিলবোর কেমন খটকা লাগল। খটকার কারণ, আলখেল্লাটা রাখতে রাখতে বুড়ো দাড়িওয়ালা বামন টেবিলে আরেক বামনকে দেখে আপনমনেই বলে উঠল, “তাহলে ওরা সবাই আসতে শুরু করেছে।” বিলবো ঠিক বুঝতে পারল না “ওরা সবাই আসতে শুরু করেছে” কথাটার মানে কি হতে পারে! কোন বামনের তো আসার কথা ছিল না। আর যার আসার কথা ছিল তার তো খবরই নেই। তবে এসব নিয়ে ভাবার সময় পেল না সে, কারণ তার মাথায় ঘুরছে কেকের কথা। শুধু গ্যান্ডালফের আসার কথা ছিল, সেহিসেবে শুধুমাত্র অতিরিক্ত একজনের জন্যই কেকের ব্যবস্থা করেছে সে। এখন আরও একজন চলে এসেছে। কেক তো কম হয়ে যাবে। আর কেক কম পড়লে মেজবান হিসেবে তার ভালো লাগবে না মোটেই। এমনিতে বিলবো বেশ অতিথিপরায়ন হবিট। অতিথিরা আসলে ভালোই লাগে তার। কিন্তু অতিথিকেই যদি না চেনে তাহলে কর্তব্য কি – এ ব্যাপারে কিছু ভেবে পেল না ঐমূহুর্তে।
কিন্তু বালিন দাঁড়িয়ে আছে, এত ভাবার সময় কই? বিলবো নিঃশ্বাস বন্ধ করেই বলে ফেলল, “আসুন, একটু চা নিন!”
“চায়ের সাথে একটু বিয়ার হলে বেশি ভালো হয়, অবশ্য তাতে যদি আপনার কোন সমস্যা না থাকে। আর পারলে কয়েকটা কেক – সীড-কেক দেবেন, যদি ঘরে থাকে আর কি!” বলল বালিন নামের বামনটা।
“অবশ্যই অবশ্যই। অনেক আছে।” নিজের উত্তরে নিজেই খানিকটা অবাক হয়ে গেল বিলবো। তারপর একমগ বিয়ার আর রান্নাঘর থেকে সুন্দর লোভনীয় চেহারার দুটো সীড-কেক নিয়ে গেল বালিনের কাছে। সীড-কেক দুটো রাতের খাবারের পর খাওয়ার জন্য বানিয়েছিল বিলবো।
কেক আর বিয়ার নিয়ে বিলবো যখন টেবিলের কাছে ফিরল, বালিন আর ডোয়ালিন তখন গল্পে মশগুল। যেন বহুদিন পর দুই ইয়ার-দোস্তের দেখা হয়েছে। আসলে বালিন আর ডোয়ালিন দুই ভাই, বিলবো তো আর জানত না সেকথা। তাই একটু অবাকই হল সে। বিয়ার আর কেক টেবিলে রাখতে রাখতে আবার কলিং বেল বেজে উঠল। এবার পরপর দু’বার।
“এবার তো অবশ্যই গ্যান্ডাল্ফ্।” দরজার দিকে যেতে যেতে ভাবছিল বিলবো। কিন্তু না, এবারও বামন। এবার দুটো একসাথে। দুজনের দাঁড়িই হলুদ টাইপের, দুজনের পড়নেই নীল হুড আর রূপালী বেল্ট। প্রত্যেকের কাছে একটা করে ব্যাগ। ব্যাগে যে অস্ত্রপাতি আছে সেটা বুঝতে কোন অসুবিধাই হল না বিলবোর। আগের দুজনের মতই এই দুজনও দরজা খোলামাত্রই ভেতরে ঢুকে পড়ল। এবার এদের মেহমান স্টাইলে ভেতরে ঢুকতে দেখে মোটেও অবাক হল না বিলবো। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “আপনাদের জন্য কি করতে পারি বলুন?” বিলবোর কথা শুনে হুঁশ ফিরে পেয়ে একজন বাই করে বলে উঠল, “কিলি, আপনার সেবায় হাজির!” পাশ থেকে দ্বিতীয়জন যোগ করল, “সাথে ফিলি!”
তারপর ভেতরে টেবিলে দুই বামনকে বসে থাকতে দেখে কিলি বলে উঠল, “ও হো! বালিন আর ডোয়ালিন তো দেখা যায় আগেই এসে গেছে!”
এই বলে নতুন দুজন আগের দুজনের সাথে যোগ দিল। চার বামন এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল যেন ভুলেই গেছে যে ঘরে বিলবো নামে একটা প্রাণির অস্তিত্ব আছে আর সেই প্রাণিটা তাদের মেজবান। টেবিলের এককোণায় বসে বিলবো শুনলো, সোনা, খনি, গব্লিন্, ড্রাগন ইত্যাদি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে বামনরা । আরও বেশ কিছু ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছিল কিন্তু বুঝতে পারল না বিলবো। অবশ্য বোঝার কোন ইচ্ছাও ছিল না তার। ক্রমেই তার মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছে। এরকম হালকা খারাপ মেজাজ নিয়ে এককোণায় বসে বিলবো কেবল চায়ে একটা চুমুক দিয়েছে এমন সময় আবার সদর দরজায় ঘন্টা বেজে উঠল। এত জোরে যে মনে হল, কোন দুষ্টু ছেলে গায়ের জোরে ঘন্টার দড়িটা টানাটানি করছে।
বিলবো একটুখানি হতাশ ভঙ্গিতে অনেকটা আপনমনেই বলে উঠল, “আবার মনে হয় কেউ একজন আসলো!”
“কেউ একজন না। চারজন। শব্দ শুনেই বোঝা যাচ্ছে। আর তাছাড়া আসার সময়ও মনে হয় আমাদের পিছনেই ছিল, অবশ্য একটু দূরে ছিল!” নিজেদের মধ্যে কথার ফাঁকে বিলবোর দিকে তাকিয়ে বলল ফিলি।
বেচারা বিলবো কি বলবে বা করবে বুঝতে পারছিল না। কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, সেটাও বুঝতে পারছিল না। এই বামনরা হঠাৎ কেন তার বাড়িতে, ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতে একটু দেরি হয়ে গেলে, কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পেল না। দরজা খুলতে দেরি হওয়াতে আবার বেল বেজে উঠল জোরে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল বিলবো। দরজা খোলামাত্র, চারটা নয়, পাঁচটা বামন হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ফিলি ঠিকই বলেছে, প্রথমে চারজনই ছিল। বিলবো দরজা খোলার সময় পঞ্চমজন তাদের সাথে যোগ দেয় আগের চারজনের সাথে।
যাইহোক, আগের চারজনের মতই একই স্টাইলে এই পাঁচজনও কোমড় পর্যন্ত নুয়ে বাউ করে সম্ভাষণ জানালো বিলবোকে। সম্ভাষণের বদৌলতে নতুন পাঁচজনের নামটা জানা হয়ে গেল বিলবোর- ডোরি, নোরি, অরি, ওইন আর গ্লোইন। আগের চার বামনের আলখাল্লার পাশে এই পাঁচজনও যার যার আলখাল্লা ঝুলিয়ে দিল। নতুন যোগ হওয়া পাঁচটা আলখাল্লার দুটো বেগুনী, একটা ধূসর, একটা বাদামী আর একটা সাদা রঙের। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়া মাত্র এই পাঁচ বামনও যোগ দিল আগেরগুলোর সাথে। সবাই কেক চাইল। আর পানীয়র মধ্যে কেউ চাইল বিয়ার, কেউ কফি, কেউবা আবার এল্ (বিশেষ ধরনের বিয়ার)। তো মেজবান হিসেবে পরের বেশ খানিকটা সময় খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটলো বিলবোর।
পরিবেশন করা খাবার শেষ করতে বেশি সময় নিল না বামনরা। বিলবো কফির কেটলীটা কেবল চুলোয় চড়িয়েছে, এমন সময় দরজায় ‘ঠকঠক’ শব্দ। অবশ্য ‘ঠকঠক’ না বলে ‘ঠকাস্ ঠকাস্’ বলাই ভালো। কেউ লাঠি দিয়ে শব্দ করছে। মাত্র কয়েকদিন আগে দরজাটা রং করানো হয়েছে আর এক উজ্বুক লাঠি দিয়ে গুঁতিয়ে পেইন্টের বারোটা বাজাচ্ছে, এই ভেবে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল বিলবোর।
হন হন করে দরজার কাছে গেল সে। রাগের চোটে একটু বেশিই জোরে খুলে ফেলল দরজাটা। হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল আরও চার বামন। এরা নিশ্চয়ই দরজার উপর ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, আচমকা দরজা খুলে যাওয়ায় তাল সামলাতে না পেরে ভূপাতিত সবাই। তবে পেছনে লাঠি হাতে দন্ডায়মান গ্যান্ডাল্ফ্। মুখে মোলায়েম হাসি, তবে বিলবোর কাছে হাসিটাকে আহাম্মকের হাসি বলেই মনে হল। বুড়ো লাঠি দিয়ে ঠকাস্ ঠকাস্ করে বিলবোর সুন্দর দরজায় দাগ বানিয়ে দিয়েছে। অবশ্য আগের দিনই দরজার নতুন রঙের বারোটা বাজানোর কাজটা বেশ ভালোভাবেই করেছিল সে। আগের দিন দরজায় একটা চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল গ্যান্ডাল্ফ।
দরজা খোলা মাত্রই গ্যাল্ডাল্ফ্ বলে উঠল, “আরে! আস্তে, আস্তে! অতিথিদের দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখার অভ্যাসটা তো তোমার সাথে একেবারেই যায় না, বিলবো! তার উপর আবার হুট-হাট গুলির মত দরজা খুলছ ….! যাইহোক, পরিচয় করিয়ে দিই। বোফার, বিফার, বোম্বার আর এই হল থরিন।”
বিফার, বোফার আর বোম্বার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল, “আপনার সেবায় হাজির!” থরিন অবশ্য এসবের মধ্যে গেল না, কিছুটা বিরক্ত সে। বিফার, বোফার আর বোম্বারের সাথে মেঝেতে পড়ায় সম্মানে ঘা লেগেছে তার। বিরক্ত চোখে বিলবোর দিকে তাঁকালো সে। এই থরিনই হল বিখ্যাত থরিন অকেনশিল্ড।
ভেতরের ঢুকে তেরো বামনকে দেখে গ্যান্ডাল্ফ্ বলল, “যাক, সবাই আসলাম তাহলে!” তারপর নিঃশেষিত খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল, “খাবার কি পাওয়া যাবে কিছু নাকি সবই শেষ করে ফেলেছ তোমরা? তবে সবার আগে একটু রেড ওয়াইন হলে ভালো হয়, মাথাটা কেমন ভারী ভারী লাগছে।”
“আমিও রেড ওয়াইন,” প্রায় সাথে সাথে বলল থরিন।
“আর আমার জন্য জ্যাম আর আপেল-টার্ট।” থরিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল বিফার।
“আমার জন্য মিন্স-পাই আর চিজ্।” বোফার বলে উঠল।
“আমার জন্য পোর্ক-পাই আর সালাদ।” বলল বোম্বার।
চার বামনের চাহিদাপত্র শেষ হতে না হতেই ডাইনিং টেবিলে বসা বামনদের আওয়াজ আসলো, “আর কয়েকটা কেক, বিয়ার – আর কফি হলে ভালো হয়!” অর্ডার এত তাড়াতাড়ি আসলো যে কে কি চাইল বুঝতে বেশ বেগ পেতে হল বিলবোকে।
বিলবো রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল এমন সময় গ্যান্ডাল্ফ্ বলল, “সাথে কয়েকটা ডিম, একটু মুরগির মাংসও নিয়ে এসো।”
পরের ঘন্টা খানেক মেশিনের মত কাজ করল বিলবো। সব রেডি হয়ে গেলে ভোজন শুরু হল। অন্যান্য ঘর থেকে টেবিল এনে ডাইনিং টেবিলের আকার বড় করা হয়েছে, টেবিলের মাথায় বসে আছে গ্যান্ডাল্ফ্। ফায়ারপ্লেসের পাশে টুলে বসে একটা বিস্কুট খাচ্ছিল বিলবো। অবশ্য খাওয়ার ইচ্ছে আর অবশিষ্ট নেই বিলবোর, বিরস বদনে বিস্কুট চিবিয়েই যাচ্ছে।
এদিকে বামনদের খাওয়া যেন অনন্তকাল ধরে চলছে। খাওয়া আর গল্প-গুজব চলছে তো চলছেই। শেষ পর্যন্ত যেন কয়েক যুগ পর শেষ হল ম্যারাথন খাওয়া। প্লেট-গ্লাস গোছাতে গোছাতে স্বভাববশতই বিলবো বলল, “রাতে খাবারটা কিন্তু এখানেই খাবেন!”
“অবশ্যই অবশ্যই!” বলল থরিন, “রাতের খাবার শেষ হওয়ার পরেই তো আসল কাজ শুরু হবে। এখন একটু গান-বাজনা হোক! আর এগুলো সব পরিষ্কার করে ফেল।”
থরিনের কথা শেষ হতে না হতেই বারো বামন লাফ দিয়ে উঠে টেবিল পরিষ্কার করার কাজ শুরু করল। আর গ্যান্ডাল্ফ্ থরিনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু করল।
এদিকে বারো বামনের প্লেট-গ্লাস পরিষ্কার করার স্টাইল দেখে বিলবোর মনে হল, আজ আর তার একটা প্লেট-গ্লাসও আস্ত থাকবে না, সব ভাঙ্গবে। তার মায়ের কত সাধের জিনিস সব। আজ সব শেষ, একটাও আস্ত থাকবে না। বিলবোর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তারও একই কথা মনে হত। কারণ, বামনরা যেভাবে প্লেট-গ্লাসের স্তুপ দুহাতে ব্যালেন্স করে যাচ্ছিল তাতে প্লেট-গ্লাসের মালিকের ভয় পাওয়ারই কথা! কিন্তু বিলবো তো আর জানেনা যে বামনদের কাছে এসব কস্রত্ ছেলে খেলার মত। তারা যেন বিলবোর উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে আরও বেশি মজা পাচ্ছিল। মজা পাওয়ার এক পর্যায়ে এসে গানই জুড়ল সবাই,
গ্লাস ভাঙ্গো আর প্লেট ফাটাও,
নতুন হাড়ি সব চ্যাকা লাগাও
সুন্দর চামচগুলো বাকিয়ে দাও,
বিলবোর আত্মাটা উড়িয়ে দাও।
জগের হাতলটা ভেঙ্গে ফেল,
ছাই ঘষে দেয়াল করো কালো।
সুন্দর কেটলিটা গুড়িয়ে দাও,
ব্যাগিন্সের আত্মা উড়িয়ে দাও।
টেনে ছিঁড়ে ফেল পর্দা সব,
ভিজিয়ে দাও লেপ-তোষক।
গামলাগুলো বাইরে ফেলেই দাও
তেলগুলোও মেঝেতে ঢেলেই দাও।
ব্যাগিন্সের সাধের বাড়ি
লন্ডভন্ড র্ক তাড়াতাড়ি,
বিছানায় ঢাল্ তরকারি
বিলবোর প্রাণ যাক খাঁচা ছাড়ি।
বোকা বিলবো, পাস্নে ভয়,
এসব তো মনের কথা নয়।
ঘরবাড়ি সব থাকবে ঠিকঠাক,
ওরে বিলবো, তুই বেঁচে থাক।
এভাবে নানা কসরত করতে করতে সব প্লেট-গ্লাস, বাটি-ঘটি ধোঁয়া মোছা শেষ করতে খুব বেশি সময় লাগলো না বামনদের। কাজ শেষ করে সবাই যখন বসার ঘরে ফিরল তখন থরিন আর গ্যান্ডাল্ফের জরুরি কথা শেষ। চুপচাপ পাইপ টানছে দুজন।
সবাই আসার পর থরিন বলল, “তাহলে এবার গান-বাজনা শুরু হোক!”
কিলি আর ফিলি তাদের ব্যাগ থেকে দুটো ছোট ছোট বেহালা বের করে আনলো। ডোরি, নোরি আর অরির হাতে দেখা গেল তিনটা বাঁশি। বোম্বার কোথা থেকে একটা ড্রাম বের করে আনলো কে জানে। আর বিফার, বোফার হাতে নিল দুটো জাদরেল বাঁশি, এগুলোকে ভদ্রলোকরা ‘ক্লোরিনেট’ বলে চেনে। সবার শেষে থরিন হাতে নিল অতি সুন্দর একটা বীণা, সোনার বীণা।
গান শুরু হল। গানের মিষ্টি সুরে যেন সব ভুলে গেল বিলবো। সুরের মূর্ছনায় ডুবে গেল সে। সুরের হাওয়া তাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল দি হিল ছাড়িয়ে দূরে, আরও বহুদূরে।
শীতল মিস্টি পর্বত ওপারে
নীরবতায় ডুবে আছে প্রতিটি কোণ
সূর্য হাসার আগে খুব ভোরে
খুঁজতে যেতে হবে সাত রাজার ধন।
বহুকাল আগে বামনেরা যেথায়
প্রতাপ নিয়ে করত রাজ,
ভয়াল এক ময়াল দানব সেথায়
ভয়ের রাজত্ব করছে আজ।
প্রতাপশালী পর্বতের রাজা
জুরি তার মেলা যে ভার,
এলফ্-মানুষ সবার রাজা
বন্ধু হতে চাইত তার।
রাজকোষ ভরা রাশি রাশি সোনা
হাড়ি হাড়ি হীরা পান্না,
এক জীবনে সে ধন যায় না তো গোনা
বয়ে যায় রূপার ঝর্ণা।
মিস্টি পর্বত ছেড়ে বহুদূরে
নীরবতায় ডুবে আছে প্রতিটি কোণ,
সূর্য ওঠার আগেই খুব ভোরে
আনতে যাব সেই সাত রাজার ধন।
সোনা দানায় হাতের কাজে
খ্যাতি ছিল মোদের বিশ্বময়,
সেই কাহিনী পাবিরে খুঁজে
এলফ-মানুষের গান-কবিতায়।
ফিরত ঘুরে বণিক-জাহাজ
দূর-দূরান্তে প্রতিটি কোণে
সেই সুদিন নেই জেনো আজ
স্মৃতি শুধু রয়ে গেছে মনে।
মিস্টি পর্বত ছেড়ে বহুদূরে
নীরবতায় ডুবে আছে প্রতিটি কোণ,
সূর্য ওঠার আগেই খুব ভোরে
আনতে যাব সেই সাত রাজার ধন।
হাসি-খুশি আর ধনে মানে
কাটছিল দিন খুব সুখে,
অপার ঐশ্বর্যের টানে
এক শয়তান এলো মুল্লুকে।
দানবের লোভের আগুনে
পুড়ল কত হাজার ঘর,
পরিণত হল মহাশ্মশানে
মোদের সাধের মহানগর।
রূপকাথার এক সোনার দেশ,
এক নিমিষেই হল শেষ।
প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে বুকে,
মোদের ধনে স্মাগ দিন কাটাচ্ছে সুখে।
এবার মোরা নিয়েছি শপথ,
বেছে নিয়েছি বন্ধুর পথ,
ঘোচাবো মোদের জাতির অপমান
স্মাগের জীবনের হবে অবসান।
মিস্টি পর্বত ছাড়িয়ে বহুদূরে
নীরবতায় ডুবে আছে প্রতিটি কোণ,
সূর্য হাসার আগেই খুব ভোরে
আনতে যাব সেই সাত রাজার ধন।
বামনদের গান শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল বিলবো। শরীরের রক্ত টগবগ করে উঠল। ইচ্ছে হল যেন হারিয়ে যায় দূরে কোথাও, ঘুরে আসে বামনদের প্রিয় লোন্লি মাউন্টেন, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে তাদের অঢেল ধন-রত্ন! একবার অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। আবার পরমূহুর্তেই অজানা বিপদের আশংকায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল। ঘরের সবচেয়ে গোপন কোণাটায় লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল, যাতে কেউ ওকে খুঁজে না পায়, কোন বিপদ ওকে ছুঁতে না পারে! এভাবেই সময় কাটতে থাকল। সময়ের সাথে আলো কমে যেতে লাগল। একসময় বিলবো খেয়াল করল, বামনরা গান থামিয়ে দিয়েছে। কোথায় যেন ডুবে গিয়েছিল বিলবো, বামনরা কখন গান থামিয়ে দিয়েছে বুঝতেই পারেনি।
এমন সময় থরিন বলে উঠল, “কি ব্যাপার বিলবো, কোন সমস্যা?” থরিনের চোখ দেখে মনে হল যেন বিলবোর ভেতরের সবকিছু পড়ে নিচ্ছে। অপ্রস্তুত বিলবো উত্তর দিল, “না! মানে আলোটা একটু বেশি হলে ভালো হত।”
“না, অল্প আলোই ভালো।” পাল্টা জবাব দিল থরিন।
“ও আচ্ছা!” এই বলে তাড়াতাড়ি বসতে গিয়ে টুলে না বসে মেঝেতে বসল ধপাস করে। আসলে টুলেই বসতে চেয়েছিল বেচারা বিলবো কিন্তু অন্যমনস্কতার কারণে খেয়ালই করেনি যে যেখানে টুল আছে ভেবে বসেছে টুলটা আসলে সেখানে নেই, আছে আরও একটু পেছনে। এমন সময় বাজখাই গলায় গ্যান্ডাল্ফ্ বলে উঠল, “আচ্ছা, এবার থামো সবাই। থরিন কিছু বলবে।”
বেশ আনুষ্ঠানিক কায়দায় শুরু করল থরিন অকেনশিল্ড।
“গ্যান্ডাল্ফ্, সঙ্গী বামনেরা এবং প্রিয় মি. ব্যাগিন্স! আজ আমরা সবাই এখানে একত্রিত হয়েছি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। তবে সেকথায় যাওয়ার আগে, অসাধারণ আতিথেয়তার জন্য মি. বিলবো ব্যাগিন্সকে আমাদের সবার পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।” এইটুক্ু বলে বিলবোর দিকে তাকালো থরিন। কিন্তু চমকের পর চমকের শক্ পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিলবো, তাই কোন উত্তর দিতে পারলো না সে। আবার শুরু করল থরিন, “রাত পোহালেই আমাদের দীর্ঘ যাত্রা শুরু হবে। সেই লম্বা যাত্রার ব্যাপারে কথা বলতেই আজ এখানে একত্রিত হয়েছি আমরা। এ যাত্রা এমন এক যাত্রা যেখান থেকে হয়ত আমরা কেউই বেঁচে ফিরব না। অবশ্য আমাদের বন্ধু, উপদেষ্টা আর শোভাকাঙ্খী গ্যান্ডাল্ফের কথা আলাদা, হয়তোবা তার জাদুবলে সুস্থ শরীরেই ফিরবে সে। কিন্তু আমাদের কথা ভিন্ন। এই বিপজ্জনক অভিযানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা সবাই বেশ ভালোভাবেই অবগত আছি। তবে মি. বিলবো ব্যাগিন্স এবং আমাদের অভিযানের তরুণ সদস্যদের জন্য, বিশেষ করে ফিলি আর কিলির জন্য, পুরো ঘটনার অন্তত একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দরকার।”
এটাই থরিনের স্টাইল। আসল কথায় আসার আগে ভূমিকা দিতে দিতে কিভাবে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে হয় সেটা বেশ ভালোভাবেই জানে আমাদের এই অতি গণ্যমান্য বামন। থামিয়ে না দিলে থরিনের ভূমিকা অবশ্য চলতেই থাকত। কিন্তু বেচারা বিলবো এত প্রেশার আর সহ্য করতে পারল না। অভিযানে প্রাণ হারানোর ভয় আছে শোনার পরেই ওর পেটের মধ্যে প্রজাপতি উড়তে শুরু করেছিল তার ওপর আবার থরিনের লম্বা, ভয়ংকর ভূমিকার চাপ সহ্য করতে না পেরে বেচারা বেহুশই হয়ে গেল। বুঝুন কেমন আমাদের এই হবিট, যে অ্যাডভেঞ্চারে তার যাওয়ারই ঠিক নেই, সেই অ্যাডভেঞ্চারে প্রাণ হারানোর কথা শুনে অজ্ঞান হয়ে গেল সে। সব বামনরা মিলে ধরাধরি করে বিলবোকে সোফার উপরে শুইয়ে দিল। একটু পর জ্ঞান ফিরে আসলে ওর হাতে পানীয়র গ্লাস ধরিয়ে দেয়া হল। কিন্তু বিলবো তখনও এমনভাবে কাঁপছিল যেন ওর শরীরের মধ্যে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প, বেশি শুদ্ধ করে বললে বলতে হয়- শরীরকম্প, চলছে। বিলবোকে ঐ অবস্থায় রেখে নিজেদের কাজে ফিরে গেল সবাই।
সবাই আবার আগের মত গোল হয়ে বসার পর গ্যান্ডাল্ফ্ বলল, “বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়েছে! তবে ড্রাগনকে সামাল দেয়ার জন্য বিলবোর চেয়ে ভালো আর কেউ হতেই পারে না!” যেন বিলবোর অদ্ভূত আচরণের ব্যাখ্যা দিচ্ছে।
ক্রুদ্ধ ড্রাগন সম্পর্কে যদি আপনার সামান্যতম ধারণাও তাকে তাহলে আপনি অবশ্যই বুঝে ফেলেছেন যে, এইমাত্র গ্যান্ডাল্ফ্ যা বলেছে তা তিলকে তাল করার চেয়েও বেশি কিছু। তিলকে তাল করা না বলে তিলকে কাঁঠাল করা বললে হয়তো কিছুটা কাছাকাছি হবে। বিলবো তো দূরের কথা, বিলবোর পরলোকগত বিখ্যাত প্রপিতামহ বুলরোয়ারারের ব্যাপারে বললেও কথাটা অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত। বিলবোর এই পূর্বপুরুষ গায়ে-গতরে এতই বড় ছিল যে রেগুলার সাইজের ঘোড়া চালাতে কোন সমস্যাই হত না তার। এই ভদ্রলোক, বা ভদ্র হবিট, গ্রিনফিল্ডের যুদ্ধে তার কীর্তির জন্য অমর হয়ে আছে। যুদ্ধে সে হাতের গদা দিয়ে গব্লিন্ রাজা গল্ফিম্বুলের মাথায় এত জোরে মেরেছিল যে রাজার মাথা থেকে আলাদা হয়ে উড়তে উড়তে একশ গজ দূরে একটা ইঁদুরের গর্তে গিয়ে পড়েছিল। রাজা মরার পর হেরে গেল গব্লিন্রা। আর এই ঘটনা থেকেই গল্ফ খেলার জন্ম হল।
একদিকে গ্যান্ডাল্ফ্রা বিলবোর যোগ্যতা নিয়ে কথা বলছে, অন্যদিকে ধাতস্থ হতে শুরু করেছে বিলবো। হাতের পানীয় খেতে খেতে গুটি গুটি পায়ে গ্যান্ডাল্ফের দিকে এগোতে শুরু করল সে। কাছাকাছি যেতেই বিলবোর কানে আসলো, গ্লোয়িন বলছে, “ধূর! একে দিয়ে চলবে বলে তোমাদের মনে হয়? উত্তেজনার কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক ড্রাগনের সামনে গিয়ে এই কাহিনী ঘটালে আর রক্ষা আছে? আমার তো সেই প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল ভুল বাড়িতে এসে ঢুকেছি আমরা। দরজায় ওই চিহ্ন না থাকলে তো ধরেই নিতাম যে ভুল জায়গায় এসেছি। এই ক্যাব্লা হবিটকে দিয়ে আমাদের কাজ হবে না। গোবেচারার চেহারাটা দেখলে যতটা না বার্গলার*( * বার্গলার: চোর, গুপ্তধন শিকারি। দুই অর্থেই ব্যবহৃত শব্দ। বার্গলার শব্দটাই রেখে দিলাম পাঠকরা যেটা ভালো লাগে সেটাই ধরে নিন।) মনে হয় তার চেয়ে বেশি মুদি দোকানদার মনে হয়।”
ক্যাব্লা হবিট, গোবেচারা, মুদি দোকানদার নিজের নামে এসব শুনে বিলবোর মেজাজ উঠে গেল সপ্তমে। সে হুড়মুড় করে কাছে গিয়ে বলল, “আমি জানি না আপনারা কিসের ব্যাপারে কথা বলছিলেন, গুপ্তধন না যেন কি, তবে এটা জানি আমি আর যাই হই ক্যাব্লা বা গোবেচারা নই। আর আমি সেটা সময়মত প্রমাণও করতে পারব। আরেকটা কথা, আমার দরজায় কোন দাগ নেই, বুঝলেন? মাত্র এক সপ্তাহ আগে রং করেছি দরজায়। আমি সেই প্রথমেই বুঝে গিয়েছিলাম ভুল বাড়িতে এসেছেন আপনারা। আপনাদের মত পেঁচা-মুখো বামনদের সাথে আমার কোন কাজ থাকতে পারে না! চেনেন না বলেই আমাকে অকর্মা বলতে পারছেন আপনারা, চিনলে কথাগুলো বলার আগে অবশ্যই কয়েকশ বার ভাবতেন! জানেন, আমার পরদাদা বুলরোয়ারার টুক্…।” রেগে মেগে হড়বড় করে বলছিল বিলবো।
কিন্তু মাঝে গ্লোয়িন বলে উঠল, “হ্যা হ্যা, তার গল্প আমরাও ঢের শুনেছি। সেটা বহুকাল আগের কাহিনী। আমরা আজকের কথা বলছি, আপনার কথা বলছি। আপনার পরদাদা কি পারত না পারত তা দিয়ে আমাদের কিছু আসে যায় না, আপনি কি পারবেন না পারবেন এটাই আসল কথা। আর আপনার দরজায় চিহ্ন আছে। অবশ্যই আছে। কোন সন্দেহ নেই। বিশ্বাস না হলে এখনই চলুন দেখিয়ে আনি। সোজা বাংলায় বললে চিহ্নটার অর্থ দাঁড়ায়, ‘এক্সপার্ট বার্গলার, যথাযথ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করতে ইচ্ছুক।’ আর তাছাড়া গ্যান্ডাল্ফ্ও বলেছিল, এদিকে এরকম একজন বার্গলার আছে, আর বুধবারে সে কাজের ব্যাপারে ফাইনাল আলোচনা করার জন্য তার বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছে। সেজন্যই তো এসেছি, নইলে আসতাম?”
বিলবো কোন কথা বলার আগেই গ্যান্ডাল্ফ্ বলল, “হ্যা বিলবো, গ্লোয়িন ঠিকই বলেছে। দরজায় চিহ্ন আছে। আমি নিজে দিয়েছি। গতকাল সকালে। আর আমি যা করেছি তোমার ভালোর জন্যই করেছি।” তারপর বামনদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর তোমরাই আমাকে বলেছিলে, তোমাদের অভিযানের চৌদ্দ নাম্বার সদস্যকে খুঁজে দিতে। চোদ্দ নাম্বার সদস্য হিসেবে আমি মি. ব্যাগিন্সকে বেছে নিয়েছি। আর তোমাদের যদি মনে হয় আমি ভুল করেছি তাহলে তেরো জনই যাও। সাথে দুনিয়ায যত দূর্ভাগ্য আছে সেগুলোও বয়ে নিয়ে যাও। আমার কি!” এই বলে গ্যান্ডাল্ফ্ এত ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে গ্লোয়িনের দিকে তাকালো যে আর কোন কথা বলার সাহস পেল না বেচারা গ্লোয়িন।
এদিকে গ্যান্ডাল্ফ্ বলে চলল, “এ নিয়ে আর কোন কথা শুনতে চাই না আমি। আমি যখন বলেছি একাজের জন্য বিলবো পারফেক্ট তখন এটাই শেষ কথা। আর আমি যে ভুল করিনি সেটা সময় আসলেই বুঝতে পারবে তোমরা। অবশ্য ততদিন যদি বেঁচে থাকো বা কৃতজ্ঞতাবোধ বলতে কিছু থাকে তোমাদের!” তারপর বিলবোর দিকে তাকিয়ে বলল, “বিলবো, মাই বয়, আলোটা একটু কাছে আনো তো!”
বিলবো ল্যাম্পটা টেবিলে রাখার পর গ্যান্ডাল্ফ্ লালচে একটা পার্চমেন্ট টেবিলের উপর রাখল। পার্চমেন্টটা খোলার পর একটা ম্যাপ দেখা গেল। খুব গোপন ম্যাপ।
ম্যাপটা দেখার পর কৌতুহলী দৃষ্টিতে গ্যান্ডাল্ফের দিকে তাকাল বামনরা। প্রশ্নবোধক দৃষ্টির উত্তরে গ্যান্ডাল্ফ্ বলল, “থরিন, এই ম্যাপটা তৈরী করেছে তোমার দাদা থ্রর। তৈরি করার পেছনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যও আছে!”
ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে থরিন বলল, “আমার কাছে তো ম্যাপটাকে বিশেষ কিছু মনে হচ্ছে না। এই ম্যাপে যা যা আছে সেগুলোকে ম্যাপ ছাড়াও খুব ভালোভাবেই চেনে সবাই। মির্কউডের জঙ্গল কোথায়, ড্রাগন কোথায় থাকে আর কোন পথে উইদার্ড হার্থে যেতে হয় সেটা জানার জন্য কোন ম্যাপের দরকার নেই আমার।”
“একটা জিনিস খেয়াল করনি তুমি, এই ম্যাপে গোপন একটা দরজার কথা বলা আছে। ম্যাপের বাম দিকে লেখাগুলো ভালো করে পড়, তাহলেই বুঝতে পারবে। লেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, লোয়ার হল বা পর্বতের সবচেয়ে নিচের হলঘরটাতে ঢোকার একটা গোপন পথ আছে।” উত্তর দিল গ্যান্ডাল্ফ্।
“একসময় হয়তো গোপন ছিল কিন্তু এখনও যে গোপন আছে তার গ্যারান্টি কি? স্মাগ(ড্রাগন) সেখানে বহুকাল ধরে আছে। এতদিনে নিশ্চয়ই সব খুঁজে বের করে ফেলেছে ড্রাগনটা। যখন ম্যাপটা আঁকা হয়েছিল তখন হয়তো দরজাটা গোপন ছিল কিন্তু এখন হয়তো আর গোপন নেই।” বলল থরিন।
“না, সেটা সম্ভব নয়।”
“কেন?”
“কারণ পথটা খুব ছোট। মাত্র পাঁচ ফুট উঁচু। ম্যাপের লেখা অনুযায়ী মাত্র তিনজন মানুষ একসাথে ঐ পথ দিয়ে যেতে পারবে। তাও তিনজন একসাথে ঢুকতে চাইলে তিনজনকেই আঁড়াআঁড়িভাবে ঢুকতে হরে। আর এত বড় শরীরটা নিয়ে ড্রাগন তো ওই পথ দিয়ে যাওয়া আসা করতে পারবে না, তাই না?”
“আমার কাছে তো দরজাটা ছোট মনে হচ্ছে না”, মাঝখানে বলে উঠল বিলবো। যে হবিট কোনদিন শায়ারের বাইরে যায়নি আর হবিটদের ছোট ছোট বাড়ি ছাড়া আর কোন বাড়ি দেখেনি তার কাছে পাঁচ ফুট উঁচু দরজাকে বিরাট দরজা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। উপরন্তু ড্রাগনের আকার সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বিলবো আরও জোর দিয়ে বলল, “আর এত বড় একটা দরজা এতদিন ধরে গোপন থাকবে, এটা কিভাবে সম্ভব?” সত্যি কথা বলতে, এমনিতে কথার মাঝখানে কথা বলার অভ্যাসটা একেবারেই নেই বিলবোর কিন্তু ম্যাপ, গোপন পথ, গুপ্তধন ইত্যাদি শুনতে শুনতে এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে মুখবন্ধ রাখার কথা মনেই ছিল না।
গ্যান্ডাল্ফ্ উত্তরে বলল, “আছে, আছে, অনেকভাবেই গোপন থাকতে পারে। তবে সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সেখানে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। আর তাছাড়া দরজাটা এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যাতে বাইরে থেকে দরজার অস্তিত্ব কোনভাবেই বোঝা না যায়। বামনরা এভাবেই দরজা করে। কি থরিন, ঠিক বলেছি তো?”
“হুম, সেটাও ঠিক!” বলল থরিন।
“আর তাছাড়া ম্যাপটার সাথে একটা চাবিও দেয়া হয়েছে আমাকে। ছোট্ট চাবি। গোপন দরজার গোপন চাবি।” এই বলে একটা চাবি বের করে ম্যাপের পাশে রাখল গ্যান্ডাল্ফ্, তারপর থরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “যত্ন করে রেখো।” এই বলে চাবি আর ম্যাপটা থরিনের দিকে এগিয়ে দিল।
“অবশ্যই রাখবো।” তাড়াতাড়ি চাবিটা নিতে নিতে বলল থরিন। তারপর গলায় ঝোলানো নিজের সুন্দর চেইনটাকে লকেটের মত ঝুলিয়ে নিল চাবিটা। তারপর বলল, “যাক একটু স্বস্তি পাওয়া গেল। এতদিন তো আইডিয়াই ছিল না যে কিভাবে কি করব। এখন চাবি আর দরজার খবর পাওয়ার পর অন্তত একটা আশা পাওয়া গেল। আমরা তো ভেবেছিলাম পূবের দিকে এগোতে থাকব। আশা করছি লং লেকে পৌঁছানোর আগপর্যন্ত কোন বিপদ হবে না, এরপরের কর্তব্য ওখানে পৌঁছানোর পর ঠিক করব ভাবছিলাম……!”
থরিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই গ্যান্ডাল্ফ্ কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “পূবের রাস্তা সম্পর্কে যতটুকু জানি, তাতে হলফ করে বলতে পারি, এখন ঐ রাস্তা এখন বিপদের আখড়া।” কিন্তু গ্যান্ডাল্ফের কথা যেন শুনতেই পেল না থরিন, বলেই চলল, “আমরা সোজা চলে যাবো রানিং নদী পর্যন্ত। তারপর নদী ধরে ডেল শহরে। সেখান থেকে লোন্লি মাউন্টেনের সদর দরজায় খুব সহজে যাওয়া যাবে কিন্তু আমাদের কেউই সদর দরজা দিয়ে মাউন্টেনের ভেতরে ঢোকার পক্ষপাতী নয় কারণ ড্রাগন ওই পথটাই ব্যবহার করে।”
“আমারও মনে হয় সদর দরজা দিয়ে না ঢোকাই ভালো। ঐ পথ দিয়ে ঢুকতে হলে বিরাট সেনাবাহিনী দরকার, অনেক বীর দরকার। কিন্তু এদিকটাতে বীর পাওয়াটা কঠিন। তবে চেষ্টা যে করিনি তা নয়। কিন্তু বীররা সবাই অন্যান্য জায়গায় ব্যস্ত। আর স্থানীয় হবিট আর আশেপাশের এলাকার লোকজন তো যুদ্ধ-টুদ্ধের চেয়ে ছা-পোষা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতেই বেশি ভালোবাসে। এরা ভোঁতা তরবারি দিয়ে ঘাস কাটে, কুড়াল দিয়ে কাঠ কাটে আর ঢাল দিয়ে রান্নাঘরে ঢাকনার কাজ চালায়। সব মিলে এই এলাকায় বীরদের নিয়ে একটা দল বানানো আর জঙ্গলের মধ্যে সুঁই খুঁজে কাঁথা সেলাই করা একই কথা। এই জন্য দ্বিতীয় উপায় হিসেবে মি. বিলবো ব্যাগিন্সকে খুঁজে নিয়েছি আমি। সে আমাদের সংঘর্ষ এড়িয়ে কাজ হাসিল করতে সাহায্য করবে আমাদের। বিশেষ করে, একটা গুপ্ত দরজার অস্তিত্ব যখন পাওয়া গেছে তখন বার্গলারের চেয়ে বেশি কাজের আর কেই বা হতে পারে! এখন এই প্ল্যানকে কেন্দ্র করে নতুন পুরো একটা ফুলপ্রুফ প্ল্যান তৈরী করাটাই হল আসল কাজ।” এই বলে সবার দিকে চোখ বুলালো গ্যান্ডাল্ফ্।
“হুম, এটাও খারাপ হয় না।” একটু ভেবে বলল থরিন, “তাহলে এব্যাপারে আমাদের এক্সপার্ট বার্গলার মি. ব্যাগিন্স নিশ্চয়ই কিছু মন্তব্য করতে চাইবে?” বলার পর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিলবোর দিকে তাকালো থরিন।
“অবশ্যই। অবশ্যই। তবে সবার আগে কয়েকটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেয়া দরকার।” বলল বিলবো। ভেতরে ভেতরে কিছুটা কাঁপুনি অনুভব করছিল সে, তবে সেটা তেমন আমলে নিল না। তার টুক্ বংশের রক্ত জেগে উঠেছে। সে বলতে থাকলো, “যতদূর বুঝলাম তাতে একটা ড্রাগন আর অনেক সোনা-দানা নিয়ে কথা হচ্ছে। এখন আমার কথা হচ্ছে, সেই ড্রাগন বা সোনা-দানা আসলো কিভাবে, আর কেই বা সেগুলোর সত্যিকারের দাবিদার?” যতটা সম্ভব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করল বিলবো।
“হায় হায়! এখনও এসব প্রশ্ন? এতক্ষণ আমাদের কথাবার্তা শুনে কি কিছ্ইু বোঝ নি? সাত খন্ড রামায়ন শুনে বলছ, সীতা রামের মাসী?” সন্দেহ, কৌতুক আর খানিকটা রাগ মেশানো গলায় বলল থরিন।
“কিছুই যে বুঝিনি তা নয়, তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাচ্ছি।” শতভাগ বণিক কায়দায় বলল বিলবো। (কাউকে টাকা ধার দেয়ার সময় সাধারণত তার মুখের ভাব এরকম দেখা যায়, গলা এরকম শোনা যায়) যতটা সম্ভব প্রোফেশনাল ভাব দেখানোর চেষ্টা করছিল সে। বলল, “আর কাজের ঝুঁকি, অন্যান্য খরচপাতি, কি পরিমাণ সময় লাগবে, প্রাণনাশের সম্ভাবনা থাকলে সেটা কতটা, এসব কিছুও আগে থেকেই জেনে রাখা ভালো।”
“আচ্ছা, তাহলে পুরো গল্পটা শোনো।” বলল থরিন। “অনেকদিন আগের কথা, আমার দাদা থ্রর পরিবার-পরিজন আর তাঁর প্রজাদের নিয়ে চলে আসেন লোন্লি মাউন্টেইনে। ম্যাপে পর্বতটা দেখেছ তুমি। তবে জায়গাটা আবিষ্কার করেছিলেন আমাদের আরেক পূর্বপুরুষ, তাকে ‘থ্রেইন দি ওল্ড’ নামে চেনে সবাই। উত্তরের পুরাতন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে আমাদের দাদারা বসবাস করতে শুরু করলেন লোন্লি মাউন্টেইনে। সেখানে প্রচুর সোনা, হীরা, আরও অন্যান্য অনেক মূল্যবান ধাতুর খনি ছিল। প্রজারা সব খনিতে কাজ করতে শুরু করল। অল্পদিনের মধ্যে প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হয়ে উঠল আমাদের লোকজন। সাথে সাথে কারিগরি দক্ষতায় ছাড়িয়ে গেল সবাইকে। ধীরে ধীরে আমার দাদা হয়ে উঠলেন ‘কিং আন্ডার দা মাউন্টেন’ বা ‘পর্বতের রাজা’। দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খ্যাতি। অনেক মানুষ এসে আমাদের লোনলি মাউন্টের আশেপাশে বসবাস করতে শুরু করল। গড়ে উঠল বড় বড় সব বাণিজ্য কেন্দ্র। এগুলোর মধ্যে অন্যতম শহর ডেল। এই ডেল সহ আশেপাশের সব শহরের লোকজন প্রতিনিয়ত কাজের জন্য ধরনা দিত আমাদের কাছে। আবার খাবার-দাবারের ব্যাপারে আশেপাশের লোকজনের উপর নির্ভরশীল ছিলাম আমরা। শহরের লোকজন আমাদের খাবারের সাপ্লাই দিত, বিনিময়ে প্রচুর সোনা পেত। তাই খাবার সরবরাহ নিয়ে বণিকরা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দে জড়িয়ে পড়ত। এদিকে ফসল উৎপাদন করে নষ্ট করার মত সময় আমাদের ছিল না। সোনা-দানা, হীরা-জহরত নিয়ে কাজ করতে করতেই সময় পেতাম না আমরা। এভাবে ধীরে ধীরে ধন-সম্পদে ভরে উঠল আমাদের কোষাগার।
এবার আসি ড্রাগনের কথায়। জানোই তো, সোনা-রূপা, হীরা-জহরত এসব মূল্যবান বস্তুর প্রতি ড্রাগনের খুব লোভ। এসব যদিও তার কোন কাজে লাগে না কিন্তু যেকোন চকচকে জিনিস দেখলেই সেটা নিজের দখলে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যায় ড্রাগনরা। এরকম জিনিস যেখানেই যা পায়, চুরি করে নিজের আস্তানায় নিয়ে রেখে দেয়।
এসব মূল্যবান বস্তু নিয়ে যে কোন কাজ করে তা নয়, শুধুমাত্র জমানোই কাজ। শুধু জমায় আর সারাজীবন সেই ধন-সম্পদ পাহারা দেয় (যদি কেউ ড্রাগনকে মেরে না ফেলে তাহলে এই সারাজীবন মানে অনন্তকাল)। উত্তরের দিকে তখন প্রচুর ড্রাগন ছিল। এই ড্রাগনদের জ্বালা-যন্ত্রনা থেকে বাঁচতেই বামনরা সব উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে চলে আসছিল।
এই ড্রাগনদের মধ্যে একটা ছিল শয়তানের শিরমণি, যেমন শক্তিশালী তেমন লোভী। ভয়ংকর এই ড্রাগনকে সবাই ‘স্মাগ’ বলে চিনত। এই স্মাগ একদিন আক্রমণ করে বসল আমাদের লোন্লি মাউন্টেন। বিরাট ওই ড্রাগন যখন প্রথমবার লোন্লি মাউন্টেইনের মাথায় এসে বসল তখন আমি বাইরেই ছিলাম। নিজ চোখে স্মাগের ধ্বংসলীলা দেখলাম। চোখের নিমিষেই ধ্বংস হয়ে গেল সমৃদ্ধ নগরী, ডেল। তারপর লোন্লি মাউন্টেইনের সদর দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে একে একে সব বামন শেষ করল স্মাগ। তারপর যেখানে যত সোনা-দানা, হীরা-মুক্তা ছিল সব জড়ো করল একটা বড় হলঘরে। আর সেগুলো বিছানা বানিয়ে আরামে দিন কাটাতে শুরু করল। যখনই ক্ষুধা লাগে, বহুমূল্য বিছানা ছেড়ে বের হয়ে ডেল শহর থেকে মানুষ ধরে এনে খায়। মানুষের মধ্যে কুমারীদের মেয়েদের বেশি পছন্দ করত স্মাগ। এভাবেই ধীরে ধীরে ঐশ্বর্যময় ডেল হয়ে উঠল পরিত্যক্ত শহর।
এদিকে আমরা হাতে গোনা যে কজন বামন মাউন্টেনের বাইরে ছিলাম তারাও কিছু করতে পারলাম না, শুধু স্মাগকে অভিশাপ দেয়া ছাড়া। একসময় আমার বাবা আর দাদা আমাদের সাথে যোগ দিলেন। লোনলি মাউন্টেন থেকে কেই সেদিন প্রাণ নিয়ে বের হতে পারেনি, শুধু বাবা আর দাদা ছাড়া। আমি তাদের তখনই এব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু দুজনই মুখ বন্ধ করে রাখতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, সময় হলেই সব জানতে পারব।
এরপর ওই এলাকা ছেড়ে চলে আসলাম আমরা। তবে শপথ নিলাম, একদিন না একদিন ওই স্মাগের কাছ থেকে আমাদের মাতৃভূমি আমরা ফিরিয়ে নেবই। আর ওই শয়তান স্মাগকেও উচিত শিক্ষা দেব।
এখন বুঝতে পারছি, বাবা আর দাদা কিভাবে মাউন্টেনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আমার জন্য তারা ম্যাপ আর চাবি রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু গ্যান্ডাল্ফ্ সেগুলো আমাকে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল।” অনেক্ষণ কথা বলে থামল থরিন।
“আমি মোটেও এগুলো কাছে রেখে দেইনি। এগুলো আমাকে রাখতে দেয়া হয়েছিল।” বলে চলল গ্যান্ডাল্ফ্, “তোমার তো অবশ্যই মনে আছে, মরিয়ার যুদ্ধে আজগের (আজগ্ দা গব্লিন্) হাতে মারা পড়ল তোমার দাদা।”
“ হ্যা, মনে আছে। কিন্তু খবরদার! ওই আজগের নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবে না!” বলল থরিন। কথা শুনে বোঝা গেল আজগ্ নামটাকে সত্যিই ঘৃণা করে সে।
“আর তারপর পরই ২১ এপ্রিল তোমার বাবা থ্রেইন উধাও হল। গত বৃহঃপতিবার তোমার বাবা উধাও হওয়ার একশ বছর পূর্ণ হল, এরপর আর কখনও তাকে দেখা যায়নি।”
“হ্যা, সবই সত্যি।” বলল থরিন।
“তোমার বাবা আমাকে এই ম্যাপ আর চাবি দিয়ে বলেছিলেন, সময়মত তোমার হাতে তুলে দিতে। আর আমার যখন মনে হয়েছে সঠিক সময় উপস্থিত হয়েছে ঠিক তখনই তোমার জিনিস তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। এজন্য আমাকে কোনভাবেই দোষ দিতে পারনা তুমি। আর তাছাড়া তোমাকে খুঁজে বের করতেও বহু ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আমাকে। সবচেয়ে বড় কথা তোমার নামটা পর্যন্ত আমাকে বলতে পারেনি তোমার বাবা। বলার অবস্থায় ছিল না সে।”
“বুঝলাম না, চাবি যদি বাবার কাছে থাকত তাহলে বাবা কেন সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করলেন না।” সন্দেহ আর চিন্তা মেশানো গলায় জিজ্ঞেস করল থরিন। বিলবোর মনেও একই প্রশ্ন ঘুরছিল।
“মরিয়ার যুদ্ধে যাওয়ার আগেই তোমার দাদা ম্যাপ আর চাবিটা তোমার বাবাকে দিয়ে গিয়েছিল। ওই যুদ্ধে তোমার দাদা মারা যাওয়ার পর তোমার বাবা বেশ কয়েকবার লোন্লি মাউন্টেনে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনবারই সফল হতে পারে নি। থ্রেইনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল ন্যাক্রোম্যান্সারের কারাগারে। তবে থ্রেইন কিভাবে নেক্রোম্যান্সরের হাতে বন্দী হয়েছিল সেটা কোনভাবেই জানতে পারি নি।
থ্রেইনের সাথে যখন দেখা হয়েছিল তখন পাগলপ্রায় অবস্থা তার। ম্যাপ আর চাবির কথা ছাড়া আর কোন কথাই আমি জানতে পারিনি তার কাছ থেকে। এমনকি তোমার নামও না। পরে নিজের গরজে সব তথ্য খুঁজে বের করেছি।” বলতে বলতে গলাটা যেন একটু ভারী হয়ে গেল গ্যান্ডাল্ফের।
“ন্যাক্রোম্যান্সারের কারাগার? সেখানে কি করতে গিয়েছিলে তুমি?” তীক্ষè দৃষ্টির সাথে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল থরিন।
“তেমন কিছু না। একটু খোঁজ-খবর নিচ্ছিলাম। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা যে একটা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে, বুঝতে পারি নি। এমনকি, আমি গ্যান্ডাল্ফ্ দা গ্রে, সেই আমাকেও কোনরকমে জান হাতে নিয়ে পালাতে হয়েছে। তোমার বাবা থ্রেইনকে বাঁচানোর চেষ্টাতেও কোন ত্রুটি রাখিনি। কিন্তু শেষপর্যন্ত পারিনি।” বলল গ্যান্ডাল্ফ্।
“মরিয়ার গব্লিন্দের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলাম আমরা, এবার ওই ন্যাক্রোম্যান্সারকেও দেব।” সরোষে বলে উঠল থরিন।
“গাধার মত কথা বলো না। ন্যাক্রোম্যান্সার এখন অনেক বেশি শক্তিশালী, দুনিয়ার সব বামনকে আনলেও তার সাথে পেরে উঠবে না তুমি। তোমার বাবার ইচ্ছা ছিল তুমি তার অসমাপ্ত কাজ শেষ করবে। চাবি আর ম্যাপ কাজে লাগিয়ে লোন্লি মাউন্টেন পুনরুদ্ধার করবে। সেদিকে মনোযোগ দাও। আর সবদিক থেকে বিচার করলে ন্যাক্রোম্যান্সারকে শায়েস্তা করার চেয়ে, লোন্লি মাউন্টেন কব্জা করা এখন বেশি জরুরী।” জোর গলায় পুরো কথা শেষ করল গ্যান্ডাল্ফ্।
“শোনো, শোনো!” কথার মাঝখানে হঠাৎ খুব জোরে বলে উঠল বিলবো। এত জোরে বলে ফেলেছিল যে সবাই হক্চকিয়ে উঠল।
“কি শুনব?” একসাথে জিজ্ঞেস করে উঠল কয়েকজন।
নিজের বোকামিতে ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা বিলবোর। কোনরকমে বলল, “মানে, আমার কয়েকটা কথা ছিল আর কি!”
“কি কথা?”
“আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম, সবার আগে তোমাদের লোনলি মাউন্টেইনে যাওয়া উচিত। তারপর সত্যিই কোন লুকানো দরজা আছে কিনা সেটা নিশ্চিত হয়ে নেয়া উচিত। ভেতরের খবরাখবর নেয়াটাও জরুরী। এখন কি অবস্থা সেব্যাপারে তো একটু জ্ঞান থাকতেই হবে। আর একটু বুদ্ধি থাকলে ড্রাগনকে ফাঁকি দিয়ে সেটা করতেও তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।” এটুক্ু বলে একটু থামল বিলবো। এরপর প্রসঙ্গ বদলে বলল, “এক রাতের জন্য যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। এখন ঘুমাতে যাওয়া উচিত। আর কাল যাওয়ার আগে অবশ্যই সকালের নাস্তা করে যাবে তোমরা সবাই।”
“আমরা যাওয়ার আগে মানে? তুমিও যাচ্ছ আমাদের সাথে!” বলল থরিন, “তুমিই তো আমাদের গুপ্তচরের কাজ করবে, ভেতরের খোঁজ-খবর নেয়া, গোয়েন্দাগিরি করা, এসব তো তোমার কাজ। তবে হ্যা, একরাতের জন্য যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। এখন ঘুমাতে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আর কাল সকালের নাস্তায় আমার জন্য ছয়টা ডিম রাখবে, পোচ বা বয়েল করবে না, ভাজি করবে।”
এরপর একে একে অন্যান্যরা জানাতে লাগলো ব্রেকফাস্টে কে কি খেতে চায়। সবার ভাবটা এমন যেন ওদের ব্রেকফাস্ট বানানোর জন্যই জন্মেছে বিলবো। অনুরোধ-বিনুরোধের আশপাশ দিয়েও গেল না কেউ। এভাবে অন্যের কাছ থেকে অর্ডার নিতে একেবারেই অভ্যস্ত নয় সে। ব্যাপারটা ভালো লাগলো না বিলবোর।
বামনরা সবাই ঘুমানোর জায়গা তৈরী করতে শুরু করল। সবাই শোয়ার পর বিলবোও শুয়ে পড়ল। একবারে সব ক্লান্তি যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। মনে হতে লাগলো, জাহান্নামে থাক ওই পেঁচামুখো বামনদের ব্রেকফাস্ট, শান্তিমত ঘুমিয়ে নেবে সে। ততক্ষণে টুক্ বংশের রক্তের টগবগানিও কমে গেছে। তাই সকালবেলা অভিযানে বের হওয়ার চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিয়ে, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
শুয়ে শুয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বিলবো শুনলো গান গাইছে থরিন। তার বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর বেডরুমটাতে শুয়ে থরিন গুনগুন করছে-
মিস্টি পর্বত ছাড়িয়ে বহুদূরে
নীরবতায় ডুবে আছে প্রতিটি কোণ,
সূর্য হাসার আগেই খুব ভোরে
আনতে যাব সেই সাত রাজার ধন।
গানের গভীর সুর বিলবোকে ঘুমের গভীরে নিয়ে যেতে লাগলো। তবে গানের জন্যই হোক বা সারাদিনের উত্তেজনার জন্যই হোক, ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখলো আমাদের গোবেচারা হবিট। পরদিন যখন বিলবোর ঘুম ভাঙ্গলো, সূর্য তখন মাথার অনেকটা উপরে উঠে গেছে।