বুক রিভিউ: চাঁদের পাহাড়
লেখক: বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
আমি যে অল্প কয়েকজন লেখকে খুব বেশি ফ্যাসিনেটেড তাদের মধ্যে বিভূতিভূষণ একদম প্রথমদিকে। এই ভদ্রলোকের প্রতি একধরনের কৃতজ্ঞতাও কাজ করে আমার। কারন বইয়ের প্রতি আমার যে ভালোবাসা তার পেছনে বিভূতিভূষণের একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা খুঁজে পাই আমি।
ক্লাস সিক্সে স্কুলের লাইব্রেরি থেকে একটা বই চুরি করেছিলাম, বইটার নাম “চিরকালের সেরা বিভূতিভূষণ”। এক্কেবারে ছেড়া একটা বই, বাঁধাই নষ্ট হয়ে যাওয়া। বইটা চুরি করা নিয়ে কোনো আফসোস নেই আমার। কারন আমি খুঁজে না পেলে এই বই আর কেউ ধরত বলে মনে হয় না। ছোটবেলায় মা আমাকে বই বাঁধাই করা শিখিয়েছিলেন। চুরি করা বইটা মনের মাধুরী মিশিয়ে বাঁধাই করেছিলাম। বাঁধাই খুব ভালো হয়েছিল। পরে ক্লাসে এইটে উঠে আমার খুব প্রিয় এক বন্ধু বইটা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। ওই বইটা হাতছাড়া হওয়ার আফসোস আমার এখনও আছে।
বইটাতে কিশোরদের জন্য লেখা বিভূতিভূষণের কয়েকটা উপন্যাস ছিল: আম আটির ভেঁপু, চাঁদের পাহাড়, হীরা মানিক জ্বলে। পরবর্তীতে আম আটির ভেপু, আর চাঁদের পাহাড় পড়া হলেও হীরা মানিক জ্বলে আর পড়া হয়নি। গতরাতে হঠাৎ মনে হল হীরা মানিক জ্বলে একটু খুঁজে দেখি। আজকাল বইটইতে বেশ ভালোই বই পড়া হয়, তাই ঢুকলাম অ্যাপে, সার্চ দিলাম কিন্তু “হীরা মানিক জ্বলে” পেলাম না। সামনে আসল “চাঁদের পাহাড়”। পড়ে ফেললাম। নিজেকে নস্টলজিক করে ফেললাম।
পড়ার সময় বারবার কৈশোরে ফিরে যাচ্ছিলাম। প্রথমবার পড়ার সেই রোমাঞ্চগুলো ফিরে ফিরে আসছিল। একইসাথে পুরোনো সেই নির্মল সুন্দর দিনের আনন্দ, আর সেই দিন হারানোর আফসোস একসাথে মিশে একটা অবর্ণনীয় অনুভূতি হচ্ছিল। এখন লেখার সময় লজ্জা লাগছে হালকা।
চাদের পাহাড় একটা বাঙালি ছেলের গল্প। ছেলেটার নাম শঙ্কর। এই ছেলেটাকে আমরা সবাই চিনি। আমাদের মধ্যে অনেকেই শঙ্করের মাঝে নিজেকে খুঁজে পাবো। আবার না পেলেও আমাদের সবা্রই শঙ্করের মত এক দুজন বন্ধু আছে। বাংলার চিরন্তন পাড়া-গাঁ, সে গাঁয়ের পথ-ঘাট, সেখানকার সহজসরল মানুষজন, খুব চেনা মনে হবে। আমাদের মতই শঙ্করও অনেক স্বপ্ন দেখে, অর্থ সংকটে ভোগে, মাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করে।
বিছানায় শুয়ে আমরা যেমন স্বপ্ন দেখতাম একদিন খুব বড় একটা অ্যাডভেঞ্চারে যাব, বন-বাদারে ঘুরে বেড়াব, হঠাৎ গুপ্তধন খুঁজে পাব। শঙ্করও তেমন স্বপ্ন দেখত। আমাদের সাথে শঙ্করের পার্থক্যটা হল, একদিন শঙ্করের স্বপ্নটা সত্যি হয়ে গেল।
একদিন সব পিছুটান কাটিয়ে শঙ্কর চলে গেল আফ্রিকায়। শুরু হল নতুন জীবন। অনিশ্চিত সে জীবনে অনেক নতুন কিছু শিখল, সেসবের সাথে মানিয়ে নিল, বন্ধুত্ব পেল, ভালোবাসা পেল, ভালোবাসা হারালও। শঙ্কর ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে উঠল। গল্পে আমরা গাঁয়ের ছোট্ট শঙ্করকে বড় হয়ে উঠতে দেখি, হোচট খেয়ে আবার উঠে দাড়াতে দেখি, হাল না-ছাড়ার দৃঢ়তা দেখি। শঙ্করের গল্প আমাদের মাঝে আস্থা জাগায়, ফেলে আসা ভুলগুলোকে ছোট করে দেখতে শেখায়, আবার উঠে দাড়ানোর তাড়না দেয়।
বিভূতিভূষণের মত মাস্টার-রাইটারদের লেখাগুলোকে আয়নার মত মনে হয়। এদের গল্পে নিজেদেরকেই খুঁজে পাই আমরা। তাদের লেখনীর আয়নায় দেখা আমাদের সেই প্রতিবিম্ব যেন আমাদের চেয়েও গভীর। জোছনা রাতে স্রোতহীন পুকুরের টলটলে পানিতে নিজেদের আত্নার যেই অধরা প্রতিবিম্ব দেখা যায়, অনেকটা সেরকম।
চাঁদের পাহাড় যদি না পড়েন, তাহলে বিরাট পাপ হয়ে গেছে।